অগ্নিঝরা মার্চ

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অগ্নিঝরা মার্চ, বাঙালির স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতির মাস। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হচ্ছে একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয়। ১৯৭১ সালে এসে যে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে, যদিও তার গোড়াপত্তন হয়েছিল বহু বছর আগে। পরে ’৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন এবং ’৬৯’র গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে বাঙালির সেই স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতিকে স্পর্শ করে।
প্রতি বাঙালির হৃদয়ের গহীনে লালন করা তখনও অধরা ‘স্বাধীনতা’ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ‘তুমি যে সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলে, মোর প্রাণে সেই আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে, সবখানে’- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ¯্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ স্বাধীনতার অমর কাব্যের একটি পঙ্ক্তি বাঙালি জাতিকে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় বলিয়ান করে তোলে। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহার্ঘ্য স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। দিন যতই গড়াচ্ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতির আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নিচ্ছিল। একদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে স্থবির গোটা বাংলা, অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা কার্ফু দিয়েও আন্দোলন থামাতে পারছিল না। অনেক স্থানেই অহিংস আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নিতে শুরু করে।
অগ্নিঝরা মার্চের আজ তৃতীয় দিন। একাত্তরের এ দিনগুলোতে মুক্তিকামী শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ছিল বিক্ষুব্ধ, প্রতিবাদমুখর। পাকিস্তানী শাসকদের কার্ফু অগ্রাহ্য করে ঢাকাসহ সর্বত্র অসংখ্য মিছিল হয়েছে। সংবাদপত্রে যাতে দুর্বার আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হতে না পারে সেজন্য সামরিক জান্তা সেন্সরশীপ আরোপ করেছিল একাত্তরের এই দিনে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলছিল বাংলার সর্বত্র।
এদিকে একাত্তরের পহেলা মার্চ থেকেই পুরো বাঙালি জাতির দৃষ্টি ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেন- সেদিকে। আর পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা নয়, চাই মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। এই মুক্তির প্রত্যাশায় দেশের বিভিন্নস্থানে গঠিত হতে থাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ। গোপনে চলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি। এসব সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে যোগ দিতে থাকে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর দেশে তরতাজা বাঙালি যুবকরা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেলেই দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে যে কোন আত্মত্যাগে প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালিরা।
অগ্নিগর্ভ মার্চের বাঙালির প্রবল আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা। কিভাবে বাঙালির এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা যায় সে ব্যাপারে নীলনক্সা করতে থাকে সামরিক জান্তা ও তাদের এদেশীয় দোসররা। বিশ্বের কাছে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির এই বাঁধভাঙ্গা আন্দোলন-সংগ্রামের খবর যাতে কোনভাবেই যেতে না পারে সেজন্য তৎপর হয়ে ওঠে পাকি জেনারেলরা। শুধু সেন্সরশীপ আরোপই নয়, কোনভাবেই যাতে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের খবর না ছাপা হয় সেজন্য প্রতিটি সংবাদপত্রের অফিসে ফোন বা স্ব-শরীরে গিয়ে হুমকি-ধমকিও দেয়া হয়।
বাঙালি জাতির এমনই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় শুরু হয়েছিল প্রাণঘাতী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করে বীর বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি তাই নানা কর্মসূচির মাধ্যমে স্মরণ করছে দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। মাসব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি স্মরণ করবেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। ঘৃণা-ধিক্কার জানাবে স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তিকে।