কীর্তিমান পুরুষ বিমলেন্দু দাস সাধু বাবু

44

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সিলেট নগরীর লামাবাজারস্থ লালব্রাদার্স হাউসের বঙ্কুবিহারী দাস ছিলেন সিলেট শহরের নামকরা একজন গুণী ব্যক্তি। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত নামকরা পাখোয়াজ বাদক। তার নামের সাথে একটি প্রবাদ বাক্য জড়িয়ে আছে। যা বর্তমানে সিলেট নগরীর ক্বীনব্রীজ সংলগ্ন সুরমা নদীর পাড়ে অবস্থিত আলী আমজাদের ঘড়ির সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই সুপরিচিত প্রবাদটি হচ্ছে-
“বঙ্কুবাবুর দাড়ি, আলী আমজাদের ঘড়ি, চাঁদনিঘাটের সিঁড়ি, মথুর মাস্টারের বেতের বাড়ি।”
বঙ্কুবিহারী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন সিলেটের মাটি ও মানুষের মাঝে। আর এই বিখ্যাত ব্যক্তির নাতি হলেন শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু)। আবার শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু)’র পিতা শ্রী বীরেন্দ্রলাল তিনিও ছিলেন একজন গুণী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন আসামের এম.এল.এ এবং তৎকালীন সময়ে সিলেট শহরের দি এইডেড হাইস্কুল, রাজা জি.সি হাই স্কুল, মডেল হাইস্কুলের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট, ঢাকা ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেটের মেম্বার, প্রথম ফার্স্ট ক্লাস অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট পলিটেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের মেম্বার এবং লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর এইসব গুণের অধিকারী ছিলেন সেই বিখ্যাত ব্যক্তি বীরেন্দ্রলাল।
প্রিয়পাঠক এখন বিখ্যাত ব্যক্তি বঙ্কু বিহারীর নাতি শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু) যিনি সিলেটের মাটি ও মানুষের উন্নয়নে নিজের জীবন ও কর্ম একাধারে মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন তাঁর জীবন ও কর্ম আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু) শৈশবে বাড়ির পাশেই সিলেট নগরীর লামাবাজার প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। যখন তিনি এই স্কুলে পড়তেন তৎকালিন সময়ে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত ছিলো এই স্কুলের নাম পাদরি স্কুল। এরপর তিনি এই স্কুল ছেড়ে বন্দরবাজার দুর্গাকুমার পাঠশালায় ভর্তি হন এবং প্রাইমারি শেষ করে পাশ্ববর্তী রাজা গিরিশচন্দ্র (রাজা জি.সি) হাইস্কুলে ভর্তি হন। পরে ঐ স্কুল ছেড়ে তাঁর পিতা যেহেতু নগরীর দি এইডেড হাইস্কুলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেই সুবাদে তিনি এ স্কুলেই ভর্তি হন। ভর্তি হওয়ার পর শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু) এইডেড হাইস্কুলের খেলাধুলা বিষয়ক সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।
এই এইডেড হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন (এস.এস.সি) পাশ করেন। এম.সি কলেজে ইউনিয়ন না থাকায় তিনি ভর্তি হন মদন মোহন কলেজে। কলেজে ভর্তির পর খেলাধুলা বিষয়ক সেক্রেটারি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আসামের মন্ত্রী বৈদ্যনাথ মুখার্জির ছেলে মানিক মুখার্জি। সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু) বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং পরে সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থা’র সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। তখন তার সঙ্গে ছিলেন এম.সি কলেজের কমরুজ্জামান (কমরু মিঞা)। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তিনি কলকাতার তিনটি দল সিলেটে নিয়ে আসেন। যেগুলো হচ্ছে মোহনবাগান, ইস্ট বেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং আর একটি দল গৌহাটির মহারাণা ক্লাব। তারপর তিনি শিলচারের সব দল যেমন ফুটবল দল, ক্রিকেট দল, ভলিবল দলকে এবং অন্যতম গৌহাটি মহারাণা ক্লাবের অন্যতম বিখ্যাত খেলোয়াড় সরল দাসকেও সিলেটে নিয়ে আসেন।
জেলা পর্যায়ের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তখনকার ডি.সি এস.এম. ওয়াসিম এর সহযোগিতায় সেক্রেটারি স্টেডিয়াম পদে নিযুক্ত হন সাধু বাবু এবং স্টেডিয়াম কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির মেম্বার ছিলেন আমিনুর রশিদ চৌধুরী, ফজলুর রাহমান (ইঞ্জিনিয়ার)। যখন সাধু বাবু জেলা পর্যায়ের সেক্রেটারি ছিলেন তখন তিনি সিলেট স্টেডিয়াম করার স্বপ্ন দেখতেন। হবিগঞ্জ সাবডিভিশনের জালাল সাহেব এস.ডি.ও স্টেডিয়ামের কাজ আরম্ভ করেন। তখন সিলেটের ডি.সি ছিলেন ড. আই.এস. ওসমানী। তারপর আবার ডি.সি আলি হাসান আসার পর শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু) আবার চেষ্টা করেন স্টেডিয়াম করার জন্য। তখন সাধু বাবুকে দু’জন ডি.সি -ই বলেন আপনি সরকারের পক্ষ থেকে জায়গা না পাওয়ায় স্টেডিয়াম সম্ভব নয়। পরে ডি.সি এস.এম. ওয়াসিম সিলেটে আসেন। তখন সিলেট স্টেডিয়ামে একজিভিশন ম্যাচ চলছিলো। একপর্যায়ে সার্কিট হাউস থেকে তিনি ডি.সি ওয়াসিম সাহেবকে খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে নিয়ে আসেন। খেলা উপভোগ করার পর সিলেট স্টেডিয়াম না থাকায় তিনি দু:খ প্রকাশ করেন। ডি.সি ওয়াসিম সিলেট আসার পরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একজিভিশন হয়। তখন একজিভিশন কমিটি হয় এবং ডিসিকে পৃষ্ঠপোষক এবং এস.ডি.ও ওহিদুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট করা হয় এবং শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু) সাধারণ সম্পাদক হন। একজিভিশনে সব খরচ শেষে আয় হয় ২০ হাজার টাকা। সাধু বাবু এই ২০ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা স্টেডিয়াম কমিটির জন্য, ৫ হাজার টাকা ডি.সি’র রিলিফ ক্যাম্পে এবং বাকি ৫ হাজার টাকা মির্জাজাঙ্গাল জুনিয়র স্কুলে বরাদ্দ দেন। এর কিছুদিন পর গভর্নর আজম খান সিলেটে আসেন। শ্রী বিমলেন্দু দাস (সাধু বাবু) তখন স্টেডিয়ামের পক্ষ থেকে গভর্নর আজম খানকে মানপত্র প্রদান করেন। এই মানপত্র দেওয়ার আগে সিলেটের ডি.সি তাকে বলেন, এমন কিছু মানপত্রের সাথে দেওয়া উচিত যা সিলেটে বিখ্যাত। এরপর তিনি লামাবাজারের সাজ সিং -কে দিয়ে রূপা দিয়ে তিনটি আনারস তৈরী করে সেই মানপত্রের সঙ্গে গভর্নরকে উপহার দেন।। তারপর গভর্নর সাহেব অভিভূত হয়ে এমন উপহার ও সম্মান পেয়ে স্টেডিয়ামের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন এবং ডি.সি ওয়াসিম সাহেব জেলা পরিষদ থেকে আরো ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। সাধু বাবু এই টাকার বরাদ্দ পেয়ে এবং ডি.সি সাহেবের অর্ডার পেয়ে স্টেডিয়ামের কাজ শুরু করেন। তিনি প্রথমে রিকাবীবাজারের জেলা স্টেডিয়ামের চারদিকে দেয়াল দেওয়ার কাজ শুরু করেন এরপর স্টেডিয়ামের গ্যালারি এবং তারপর বাহির দিকে দোকান কোঠা তৈরী করেন স্টেডিয়ামের আয়ের জন্য।
ডিসি সাহেবের অফিসের চারদিকে যে দোকানগুলো ছিলো সেই দোকানগুলোকে ৫০০ টাকা সালামি ও মাসিক ৩০ টাকায় স্টেডিয়ামের দোকানে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি স্টেডিয়ামে দোকান কোঠা বরাদ্দের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেন কিন্তু সেই বিজ্ঞপ্তিতে কোন ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে স্টেডিয়াম কমিটিকে বলেন যদি কমিটির মেম্বাররা দোকান নিতে ইচ্ছুক হন নিতে পারেন। পরে স্টেডিয়াম কমিটির সব মেম্বার ৫০০ টাকা সালামি ও ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে দোকান নিতে রাজি হন।
সাধু বাবু ডি.সি সাহেবের অনুমতি নিয়ে নাজমুল হুদাকে ৭৫ টাকা বেতনে স্টেডিয়ামের হেডক্লার্ক নিযুক্ত করেন। নাজমুল হুদা স্টেডিয়ামের ক্লার্ক নিযুক্ত হওয়ার পর স্টেডিয়ামের কাজ আরম্ভ করেন সাধু বাবু এবং স্টেডিয়াম তৈরী করার জন্য সরকার পক্ষের সব কাজকর্ম তার সহযোগিতায় সম্পন্ন করা হয়।
স্টেডিয়াম কমিটি ক্লার্কের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার বেতন ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করে দেন। কিন্তু ক্লার্কের আপত্তিতে সাধু বাবু তার (ক্লার্কের) কথা মতো বেতন ৮৫ টাকা করে দেন।
তারপর স্টেডিয়ামের কাজ সুন্দরভাবে চলতে থাকে। কিন্তু মাঠের ভেতরের গাছ কাটা নিয়ে তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। তখন এ.ডি.সি সাদেক সাহেবের হস্তক্ষেপে পরবর্তীতে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়। (চলমান)