আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
তাড়িত দুঃখের মতো চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল/রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ, উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে/ তীরের ফলার মতো/ নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার ঃ বাংলা, বাংলা…..। এই বাংলা ভাষারই জন্য বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি জ্বলে উঠেছিল দ্রোহের আগুন। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল রাজপথ। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বিদ্রোহী হয়েছিল তরুণের তাজা প্রাণ। ঢাকার সড়কে বয়ে গেছে রক্তের ¯্রােতধারা। বায়ান্নর পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই ঘটেছে উত্তাপ ছড়ানো নানা ঘটনাপ্রবাহ।
ইতিহাসের বাঁক ফেরানো তেমনই একদিন ছিল ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। আগুনঝরা আন্দোলন গড়ার প্রতীক্ষায় উদগ্রীব ছিল পুরো জাতি। দেশজুড়ে বিরাজ করছিল প্রবল উত্তেজনা। পরদিন কেমন হবে প্রতিবাদের দৃশ্যপটÑ সেটা নিয়ে চলছিল তুমুল আলোড়ন। আর সেই আলোড়নের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আন্দোলনের ডাক দেয়া ছাত্ররা ছিলেন প্রতিজ্ঞায় অবিচল। তাই বর্তমানের এই দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার দেখে উপলব্ধি করা যায় না ১৯৫২ সালের সেই দিনটির কথা। সেদিন ছাত্রদের আন্দোলনের প্রস্তুতির তীব্রতা ও অনমনীয় ভাব দেখে পূর্ববঙ্গ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে দেয়। সরকারী এক নির্দেশে বলা হয়, ‘ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারার আদেশ জারি করিয়া এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষিদ্ধ করিয়াছেন। আদেশ জারির কারণ সম্পর্কে বলা হয়, একদল লোক শহরে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রয়াস পাওয়ায় এবং তদ্বারা জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এই ব্যবস্থা অবলম্বিত হইয়াছে। কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, লালবাগ, রমনা ও তেজগাঁও থানার অন্তর্গত সমুদয় এলাকায় ইহা প্রবর্তিত হইয়াছে।’ মূলত জনমনে ভীতি ও ত্রাস সঞ্চারের চিরাচরিত পন্থাই সরকার গ্রহণ করেছিল। তবে এসব ভয়-ভীতিতেও দমানো যায়নি ছাত্রদের।
সরকারের ১৪৪ ধারা প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে একুশের কর্মসূচী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদের যে বৈঠক হয়, সেখানে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হয়। তবে ছাত্ররা বিশেষ করে অলি আহাদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ বিরোধিতা করে সেই সিদ্ধান্তের। অলি আহাদ বলেছিলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। আগামীকাল (২১ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্রসভা হবে তাতে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যদি রায় হয়, তবে আমরা ভাঙ্গার পক্ষে।’
এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক বলেছেন, অলি আহাদ, মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি গোলাম মওলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন- এরা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি শামসুল আলম এদের সমর্থক ছিলেন।
সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মাঝখানের পুকুরের পূর্বপাড়ে মিলিত হন কয়েকজন ছাত্র। এদের মধ্যে ছিলেন- মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মুহম্মদ সুলতান, আবদুল মমিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দিন শহুদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার মুকুল প্রমুখ। তারা সেখানে আমতলার সভায় কীভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে তা ঠিক করেন। পাশাপাশি এই ১৪৪ ধারার ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তিনটি পক্ষ- সাধারণ ছাত্ররা, যুবলীগের নেতা ও কর্মীরা এবং ছাত্রনেতাদের কয়েকজন পৃথকভাবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এসে।
পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভায় এর যে প্রতিফলন ঘটেছিল, তা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসেই শুধু নয় বাঙালী জাতির পরবর্তীকাল ও বর্তমানেও বাংলাদেশের যে কোন আন্দোলন সংগ্রামের জন্য প্রেরণাদায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে উড়ে গিয়েছিল ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের হিসাব-নিকাশের রাজনীতি। বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালী খুঁজে নিয়েছিল আপন মুক্তির পথরেখা।