চলে গেলেন বাপ্পি লাহিড়ীও

27

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারতীয় উপমহাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, বলিউডের ডিস্কো কিং বাপ্পি লাহিড়ী মঙ্গলবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে মুম্বাইয়ের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বুধবার সকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে। মৃত্যুকালে এই সঙ্গীতশিল্পীর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
পরিবারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার বাপ্পি লাহিড়ীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। একইসঙ্গে জানানো হয়, বাপ্পি লাহিড়ীর একমাত্র পুত্র বাপ্পা যুক্তরাষ্ট্রের লস এ্যাঞ্জেলেসে বসবাস করেন। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে ভারতে এসে পৌঁছাবেন তিনি। তারপরই মুম্বাইয়ের পবন হংস মহাশ্মশানে বাপ্পি লাহিড়ীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে পরিবারের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, আমাদের কাছে এটা চরম শোকের একটা মুহূর্ত। প্রিয় বাপ্পিদা আমাদের ছেড়ে পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। তার আত্মার জন্য দয়া করে শান্তি কামনা করুন। জানুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বাপ্পি লাহিড়ীকে। এরপর অল্প কিছু সময়ের জন্য বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই মৃত্যু হয় তার। এর আগে ২০২১ সালের এপ্রিলে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। তারপর থেকেই অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ এ্যাপনিয়ায় (ঘুম সম্পর্কিত শ্বাস-প্রশ্বাসের একটি ব্যাধি) ভুগছিলেন তিনি। ১৯৭০ থেকে ৮০-এর দশকে হিন্দি ছায়াছবির জগতে অন্যতম জনপ্রিয় নাম বাপ্পি লাহিড়ী। ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘চলতে চলতে’, ‘শরাবি’-তে সুর দিয়েছেন তিনি। গেয়েছেন একাধিক গান। ২০২০ সালে তার শেষ গান বাগি-৩ এর জন্য। বাবা অপরেশ লাহিড়ী ও মা বাঁশরী লাহিড়ী দুজনেই সঙ্গীত জগতের মানুষ। ফলে একমাত্র সন্তান বাপ্পি ছেলেবেলা থেকেই গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। মা-বাবার কাছেই পেয়েছিলেন প্রথম গানের তালিম। মা-বাবা নাম দিয়েছিলেন অলোকেশ, কিন্তু জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন বাপ্পি নামে। ১৯৫২ সালের ২৭ নবেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বাপ্পি। তারপর দীর্ঘদিন বাংলা ও হিন্দি ছবির গান গেয়েছেন, সুর দিয়েছেন। শরীরে প্রচুর সোনার গয়না পরতে ভালবাসতেন তিনি। বাপ্পি লাহিড়ী রাজনীতিতেও নেমেছিলেন। বিজেপিতে যোগ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর কেন্দ্র থেকে ভোটেও লড়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে কখনওই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি তিনি। কিন্তু অনেকেই মনে করতেন বাপ্পি লাহিড়ী মানেই হয়ত শুধু ডিস্কো কিং আর ঝলমলে গয়না।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক : ভারতের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে এক শূন্যতা সৃষ্টি হলো, যা কখনই পূরণ হবার নয়। রাষ্ট্রপতি এই সুরস্রষ্টার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোক বার্তায় প্রয়াত শিল্পীর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদি-অমিতের শোক : বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি টুইট করে লিখেন, বাপ্পি লাহিড়ীর সমস্তটা জুড়ে ছিল সঙ্গীত, নানা ধরনের আবেগকে তিনি অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার কাজ মনে রাখবে। প্রাণবন্ত স্বভাবের জন্য তার অভাব বোধ করবে। তার মৃত্যুতে শোকাহত। পরিবার ও অনুরাগীদের প্রতি সমবেদনা ও শান্তি। পাশাপাশি বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি টুইট করে লিখেন, কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী-সুরকার বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে শোকাহত। তার প্রয়াণ ভারতীয় সঙ্গীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতি। বহুমুখী প্রতিভা ও প্রাণবন্ত স্বভাবের জন্য বাপ্পিদা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ইনস্টাগ্রামে লাহিড়ীর শেষ পোস্ট : মৃত্যুর দুইদিন আগে সামাজিক মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। ওই পোস্টে সাদা-কালো একটি পুরনো ছবি শেয়ার করেছিলেন তিনি। যেখানে, সানগ্লাস ও সোনার চেন পরা অবস্থায় দেখা গেছে তাকে। এই পোস্টের ক্যাপশনে বাপ্পি লাহিড়ী লিখেন, ‘ওল্ড ইজ অলওয়েজ গোল্ড’। অর্থাৎ- অতীত সব সময়ই সোনালি। মৃত্যুর আগে এক মাস ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। হাসপাতালটির পরিচালক ডাঃ দীপক নামযোশী বলেন, এক মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন লাহিড়ী, সোমবার তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছিল। তবে মঙ্গলবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, বাপ্পি লাহিড়ীর বেশকিছু শারীরিক জটিলতা ছিল। মধ্যরাতের কিছু আগে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ এ্যাপনিয়ায় (ওএসএ) তার মৃত্যু হয়।
দুই প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ : সঙ্গীত জগতে পর পর দুটি নক্ষত্রের পতন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর রাতেই মুম্বাইতে প্রয়াত হন আরেক বাঙালী সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী। ফলে দুই বাঙালী শিল্পীর প্রয়াণে বাংলায় শিল্পীমহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বুধবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। আর আজ বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ে বাপ্পি লাহিড়ীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার কথা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেন, ‘সন্ধ্যা দিদির সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। তার মৃত্যুতে আমি আমার অগ্রজকে হারালাম।’ এদিন দুপুর ১২টা নাগাদ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃতদেহ আনা হয় রবীন্দ্রসদনে। সেখানেই শায়িত থাকবেন বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। রবীন্দ্রসদনে তার নশ্বর দেহকে শেষ সম্মান জানান বাংলার বিশিষ্টজন থেকে সাধারণরা। পাশাপাশি রবীন্দ্রসদনের একতারা মঞ্চে রাখা হয়েছে বাপ্পি লাহিড়ীর প্রতিকৃতি। সেখানেও শ্রদ্ধা জানান সকলে। এই দুই প্রয়াত বাঙালী সঙ্গীতশিল্পীকে সকলেই শ্রদ্ধা জানান।
ভারতের প্রথম রকস্টার : ভারতের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে দেশটির সঙ্গীতাঙ্গনে। একের পর এক তারকারা শোক জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন। কিংবদন্তি এই সঙ্গীতশিল্পীকে নিয়ে টুইট করেছেন আরেক সঙ্গীতশিল্পী আদনান সামি। বাপ্পি লাহিড়ী ভারতের প্রথম রকস্টার ছিলেন বলেও জানান তিনি। আদনান সামি লিখেন, ‘বাপ্পি লাহিড়ী ভারতের প্রথম রকস্টার। তার হৃদয় ভালবাসা ও উদারতায় পূর্ণ ছিল। তাকে খুব মিস করব।’
গিনেস রেকর্ডে নাম : কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী বিশ্ব রেকর্ডও করেছেন। ৩৩টি ছবির জন্য ১৮০টি গান রেকর্ড করে ১৯৮৬ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম তুলেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। এমনকি জনাথান রসের লাইভ পারফর্মেন্সে আমন্ত্রণ পাওয়া একমাত্র ভারতীয় মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। এরপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিস্তৃত তার সঙ্গীতজীবন। রোমান্টিক থেকে শুরু করে ভজন, কাওয়ালি, রাগাশ্রয়ী গান থেকে শুরু করে ডিস্কো সঙ্গীত, সবকিছুতেই তার অনেক যাতায়াত। নিজের গান দিয়ে নাচিয়ে ছেড়েছিলেন ছোটবড় সবাইকেই।
৫ কেজি ৩৫৪ গ্রাম সোনা-রুপা ব্যবহার করতেন : ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তার ব্যবহৃত সোনা-রুপার পরিমাণ ৫ কেজি ৩৫৪ গ্রাম। ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এই গায়ক। সেই সময় মনোনয়নপত্রে সোনা-রুপার পরিমাণ উল্লেখ করেন। তখন জানা যায়, ভারতীয় এই গায়ক ৭৫৪ গ্রাম সোনা ও ৪ কেজি ৬২০ গ্রাম রুপার মালিক। এই সবই তাঁর গলার চেন, ব্রেসলেট, হাতের ঘড়িসহ অন্যান্য ব্যবহৃত অলঙ্কার বা গয়না। গলায় সবসময় চারটির বেশি সোনার চেনসহ নানা অলঙ্কার পরতেন বাপ্পি লাহিড়ী। তবে এসব শখে নয়। এগুলোকে তিনি ‘আশীর্বাদ’ মনে করে ব্যবহার করতেন। তিনি মনে করতেন, সোনা-রুপা ব্যবহারের পর তার ভাগ্য খুলতে থাকে; অর্থাৎ এগুলো ব্যবহার করলে তার গান সুপারহিট হবে। সেই থেকেই তার সোনা-রুপার ব্যবহার বাড়তে থাকে।