ওসমানীনগরে অর্থের বিনিময়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাচ্ছে বিত্তশালীরা, বঞ্চিত প্রকৃত ভূমিহীনরা

11

শিপন আহমদ, ওসমানীনগর থেকে :
মুজিব শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ প্রকল্প আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ আওতায় ওসমানীনগরে প্রকৃত ভূমিহীন পরিবারকে বঞ্চিত রেখে অর্থের বিনিময়ে বিত্তশালী পরিবারকে ঘর দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইউএনও, এসিল্যাড অফিসের সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা, ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা, একাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী লোকজনের যোগসাজে উপজেলা জুড়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে সূত্রে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ উদ্যোগ ঘর বিত্তশালীদের পাইয়ে দেয়া থেকে শুরু প্রকল্পের জায়গা নির্ধারণ ও ঘর নির্মাণসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নানা দুর্নীতির চিত্র এখন প্রকল্প এলাকার সংশ্লিষ্ট স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে রটনার পাশাপাশি একাধিক ভোক্তভোগীদের মামলা-মোকদ্দমার শরণাপন্ন হতে দেখা যাচ্ছে। একাধিক দুর্নীতির বিষয় আবারও অভিযোগকারীদের উপজেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা ভাবে ম্যানেজ করে গোপনে নিষ্পত্তি করতে দেখা যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসনের জনৈক্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের।
উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের অর্থের বিনিময়ে একই বিত্তশালী পরিবারকে দুটি ঘর দেয়া হলেও একই এলাকার এক গৃহহীন সংশ্লিষ্টদের টাকা দিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়ায় বর্তমানে ঝুপড়ি ঘরে মানবেতর ভাবে বসবাস করছেন। ঘরের জন্য দেয়া টাকা বা ঘর কোনটাই না পেয়ে দিশেহার ভূমিহীন আছিয়া বেগম অবশেষে এ ঘটনায় ৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অভিযুক্তরা হচ্ছেন-আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়া, সাদীপুর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকতা সহকারি অনিল সিংহ, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দ প্রাপ্ত হাসুরা বেগমের ২ ছেলে নুর মোহাম্মদ ও নুর জামান।
মামলা সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নে বাংলাবাজার এলাকায় সম্মানপুর মৌজার ৮৩৫ দাগের সরকারি খাস ভূমিতে ৩টি ঘর নির্মাণ করা হয়। উক্ত ভূমিতে বিগত ২২ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বাস করছিলেন মোছা. আছিয়া বেগম। তার স্বামী রিক্সা চালক রুবেল মিয়া সাদিপুর ইউনিয়ন কর্তৃক ভূমিহীন সনদপ্রাপ্ত। গত ২ এপ্রিল ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা অনিল সিংহ, আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়াসহ কয়েকজন আছিয়া বেগমকে জানান উক্ত ভূমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩টি ঘর নির্মাণ হবে। এরমধ্যে একটি ঘর আছিয়া বেগমকে দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতিতে তাকে জমি খালি করতে বলেন। এরপর আছিয়া বেগম সরকারি ভূমি ছেড়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে স্বামী সন্তানকে নিয়ে বাস করছেন।
পরবর্তীতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে খরচ বাবদ আছিয়া বেগমের কাছে ৩০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। গত ১১ জুন আছিয়া বেগম উক্ত টাকা আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়া, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত নুর মোহাম্মদ ও নুর জামানের হাতে তুলে দেন। আগস্টের শেষ দিকে ঘর নির্মাণ হলে একটি ঘর আছিয়া বেগমকে মৌখিকভাবে সমঝে দেওয়া হয়। গত ১ অক্টোবর বিকেলে আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন অভিযুক্তরা। আছিয়া বেগম টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে স্বামী-সন্তানসহ আছিয়া বেগমকে মারপিট করে জোরপূর্বক ঘর থেকে বের করে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত নুর মোহাম্মদ এবং তার মা হাসুরা বেগম ভূমিহীন না হয়েও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ও ইউপি ভূমি সহকারি কর্মকর্তা সহায়তায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্ধ পেয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত ৩টি ঘরে দিনমজুর নজরুল মিয়া, টমটম চালক নূর মোহাম্মদ ও হাসুরা বেগম (নুর মোহাম্মদের মা) বরাদ্দ পেয়েছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অদূরেই ৩ ছেলের মা হাসুরা বেগমের নিজ নামীয় ৫ শতক ভূমি ও তার উপর নির্মিত একটি টিনশেডের পাকা ভবন রয়েছে। হাসুরা প্রথম সন্তান আব্দুল কাদির প্রবাসী, ২য় ছেলে টমটম চালক নূর মোহাম্মদ (আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছেন) ও ৩য় ছেলে পিক-আপ চালক নুর জামান মায়ের সাথে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পৃথক ঘরে বাস করছেন।
অভিযোগকারী আছিয়া বেগম বলেন, আমরা দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এ ভূমিতে ঘর বানিয়ে বাস করছি। বসত বাড়ির ইউপি ট্যাক্স প্রদান করছি। আমার স্বামীর নামে ভূমিহীন সনদ রয়েছে। নিজস্ব বৈদ্যুতিক মিটারও রয়েছে। আমাদের উক্ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ৩টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। নিজেদের বাড়ি রয়েছে এমন পরিবারের ২ জনের জন্য ২টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আহবাব মিয়া ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তার চাহিদা মাফিক টাকা দিতে না পারায় আমি কোন ঘর পাইনি।
অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়া বলেন, আমি জনপ্রতিনিধি নই। ঘর বরাদ্দের ব্যাপারে কোথাও আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আছিয়া বেগম উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছেন।
নিজের নামে কোন ভূমি নেই দাবি করে হাসুরা বেগম আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দের দলিল দেখিয়ে এই প্রতিবেদকে জানান, তার ছেলে নূর মোহাম্মদ পরিবার থেকে আলাদা। তাই নুর মোহাম্মদের নামে আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। তার (হাসুরা বেগমের) মালিকানায় ভূমির দলিল রয়েছে জানালে তিনি বলেন-এসব মিথ্যা।
হাসুরা বেগমকে ভূমিহীন সনদ প্রদান প্রসঙ্গে স্থানীয় সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মহিলা ইউপি সদস্য আলেয়া বেগম বলেন, আমি মহিলা হয়ে সব জায়গায় যাওয়া বা সবকিছু ভালো করে যাচাই করা সম্ভব নয়। স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সনাক্তের ভিত্তিতে আমি হাসুরা বেগমকে ভূমিহীন সনদ দিয়েছি। পরবর্তীতে জেনেছি হাসুরার নিজস্ব বাড়ি রয়েছে।
ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা অনিল সিংহ বলেন, ভূমিহীন সনদ পেয়েই হাসুরা বেগমের নামে বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। ঘর ৩টি, দাবিদার ৪ জন। যারা আগে যোগাযোগ করেছে তারা ঘর বরাদ্দ পেয়েছে। আছিয়া বেগমের জন্য অন্যত্র ঘরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সাদিপুর ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা কবির উদ্দিন আহমদ বলেন, আছিয়া বেগমের ঘর না পাওয়ার বিষয়টি অমানবিক। এতে জননেত্রী শেখ হাসিনার মহৎ উদ্যোগটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে একাধিকবার কথা হয়েছে। হাসুরা বেগমের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই মহিলা ভুয়া হলফনামা দিয়ে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। আর্থিক কেলেংকারির বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আমি হাসুরাকে ৩ দিনের মধ্যে ঘর ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেছি।
উপজেলার সচেতন মহল জানান, শুধু সাদীপুর ইউনিয়ন নয় সবকটি ইউনিয়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের জায়গা নির্ধারণ সহ নির্মাণ কাজে অনিয়ম করা হয়েছে। যা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মুখ খুললে কখনও ঘর পাওয়া যাবে না এমন ভয় দেখিয়ে উপকারভোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভাবে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাই ঘর না পেয়েও পরবর্তী ধাপে পাওয়ার আশায় এ ব্যাপারে কেউ মুখ খোলতে রাজি হচ্ছে না। সর্বোপরি উপজেলার আশ্রয়ন প্রকল্পের জায়গা নির্ধারণ থেকে শুরু করে ঘর নির্মাণসহ উপকারভোগী বাছাইয়ের চিত্রগুলো প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহল থেকে গভীর ভাবে খতিয়ে দেখার আহবান জানান তারা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নীলিমা রায়হানা বলেন, এসব আমি এ উপজেলায় যোগদানের পূর্বের ঘটনা। তাই সব স্পষ্ট বলতে পারবো না। তবে আমি আছিয়া বেগমের বিষয়টি জেনে তার জন্য ঘর বানিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছি। আর হাসুরা বেগমের যদি নিজস্ব বাড়ি থাকে তবে তিনি কিভাবে ঘর পেলেন এখানে কোন প্রকার দুর্নীতি রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।