আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ॥ গরীবের টাকা লুট করে পাচার করা দলকে জনগণ ভোট দেবে না

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশের এত উন্নয়নের পরও দেশ-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে এমন লোকজন সম্পর্কে দলের নেতাকর্মীদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এখনও দেশ-বিদেশে বসে আমাদের কিছু লোক আছে যত ভালো কাজই আমরা করি না কেন তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে, অপ্রচারের জবাব দিতে হবে। আর বিএনপিকে কোন আশায় মানুষ ভোট দেবে? দন্ডিত পলাতক আসামি যে দল (বিএনপি) চালায়, তাদের কী আশায় জনগণ ভোট দেবে? গরিবের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা দলকে জনগণ কখনও ভোট দেবে না। শুক্রবার তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সভাপতির সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সবসময় আমিই ছিলাম খালেদা জিয়ার প্রধান টার্গেট। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকেই আমি মনে করি যে, এদের অপকর্মগুলোর কথা মানুষকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত। সেই সময়ে বিএনপির হাতে যারা নির্যাতিত তাদের নিজেদের অন্য বক্তৃতা করার দরকার নেই, বিএনপি তাদের ওপর কী অত্যাচার করেছে সেটা মানুষকে জানানো উচিত। যাতে আমাদের এই বুদ্ধি বিকিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের বুদ্ধির গোড়ায় অন্তত কিছুটা হলেও যেন জ্ঞান ঢোকে এবং বাস্তব অবস্থাটা যেন তারা জানতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, কিছু মানুষ মিটিং করছে কি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় না রাখা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের অপরাধটা কী? আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়ন করছে এটাই কী অপরাধ? বাংলাদেশের মানুষ এখন দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারে। এখন আর ক্ষুধার্ত-শুকনো মানুষগুলোকে দেখিয়ে দেখিয়ে বিদেশ থেকে পয়সা কামাই করতে পারছে না, এটাই তাদের দুঃখ।
সরকারপ্রধান বলেন, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়নের চাকা ঘুরছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। অনেক অযথা এবং অহেতুক দেশের বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার করে করে এমনকি আমরা উন্নয়নশীল দেশ কেন হলাম এটাও যেন আমাদের অপরাধ! কিন্তু তারা জানে না জনগণের শক্তিই হচ্ছে আওয়ামী লীগের শক্তি। আমরা জনগণের সেবায় কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। আমরা জনগণের সেবায় কাজ করে যাচ্ছি। আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করছি। উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর বাসভবন গণভবনে বিকেল চারটায় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকটি শুরু হয়ে অনেক রাত পর্যন্ত চলে। বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদকসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে প্রায় ৫০ জনের মতো কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের শুরুতেই দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া উত্থাপিত শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
বৈঠক সূত্র জানায়, সাংগঠনিক আলোচনার সময় গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দলের শোকজের জবাব তুলে ধরা হয়। বৈঠকে অধিকাংশ সদস্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখায় তাঁকে দলকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এরপর মেয়র জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বলেও বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া বৈঠকের শুরুতেই শূন্য থাকা তিন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য পদে তিন সিনিয়র নেতাকে মনোনয়ন দেন সভার সভাপতি শেখ হাসিনা। নতুন তিন সভাপতিমন্ডলীর সদস্যরা হলেন কেন্দ্রীয় নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং সাবেক মন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম।
সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, নির্বাচনে দেশের জনগণ বিএনপিকে কোন আশায় ভোট দেবে? এরা দেশের গরীবের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে। পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বিদেশে আরাম আয়েশে আছে। এই আয়ের উৎস কী?
প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশের কিছু সুবিধাভোগী স্বার্থান্বেষী মহলের সমালোচনা করে বলেন, আমাদের কিছু মানুষ আছে যারা হাজার অপরাধ করলেও অপরাধী হিসেবে দেখেন না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও তারা দুর্নীতির জন্য সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ নেয়। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, এতিমের টাকা আত্মসাত করে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে- এদের (খালেদা জিয়া) জন্য মায়াকান্না করছে।
‘খালেদা জিয়ার সবসময় আমি টার্গেট ছিলাম’- উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন আমি প্রধানমন্ত্রী কেন, বিরোধী দলের নেতাও হতে পারব না। শত বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারব না। খালেদা জিয়ার এমন ঘোষণার পর পরই আমার ওপর হামলা। তারপর বোমা পুঁতে রাখা হলো কোটালিপাড়ায়। এরপর হলো ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা। সব সময় আমিই ছিলাম খালেদা জিয়ার টার্গেট। আমার মনে হয় এই কথাগুলো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীর ওপর বিএনপি অকথ্য অত্যাচার- নির্যাতন করেছে। আমাদের মিটিং করতে দেয়নি। একজন আমাকে শুধু হাত দেখিয়েছিল বলে তার দাড়ি টেনে টেনে তুলেছিল। আমাদের বহু নেতাকর্মীর হাতের কব্জি কেটে দিয়েছিল। পা কেটে দিয়েছিল। চোখ তুলে ফেলা হয়েছিল। বাড়িঘর দখল করে। তাদের অত্যাচারে আমাদের ২০ হাজার নেতাকর্মী মৃত্যুবরণ করে। তারা আওয়ামী লীগের নাম নিশানাও মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
বিভিন্ন সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতার আসার পরে তার যে অত্যাচার, আমরা আওয়ামী লীগ অফিসে পর্যন্ত বসতে পারতাম না, যেতে পারতাম না, ঢুকতে পারতাম না। আমাদের সিআরআই বন্ধ করে দিয়ে ১৬টা কম্পিউটার, তিনশ’ ফাইল, দশ হাজার বই, নগদ টাকা পয়সা সব কিছু নিয়ে যায় এবং সেখানে তালা দিয়ে যায়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরে আবার সেই অফিসটা আমরা খুলতে পারি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও বলেন, এভাবে বিএনপি অকথ্য অত্যাচার করেছে। আমাদের অগণিত নেতাকর্মী কারাগারে রেখেছে। সেখানে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতে পর্যন্ত যেতে দেয়নি। শুধু আমাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে তাই নয়, সেনাপ্রধান মোস্তাফিজুর রহমান অসুস্থ ছিলেন। তাঁকেও সিএমএইচে ভর্তি হতে দেয়নি। অন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁকে স্টেচারে করে হাজির করা হয়েছে মামলার জন্য। বিমানবাহিনী প্রধান জামাল উদ্দিন সাহেব, তাঁর মতো সৎ একটা মানুষ, তাঁকে সাধারণ একটা ঘড়ি চুরির মামলা দিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছে। সেখানে তাঁকে কোন ডিভিশনও দেয়নি। তাঁকে মাত্র দুটি কম্বল দিয়েছিল। ফ্লোরে থাকতে হয়েছে তাঁকে। এরা (বিএনপি) যেভাবে অমানবিক কাজ করেছে, এরকম বহু কাহিনী আছে।
নিজেসহ দলের আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাঁদের ওপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার মনে এখানে এমন কেউই নেই যার ওপর অত্যাচার হয়নি। এভাবে তারা অত্যাচার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাচন বা তাদের বাধা দেয়নি। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের ভোটে বিশ্বাস করি।
সরকারপ্রধান বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। এই নির্বাচন নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন তোলে নাই। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ মেজোরিটি নিয়ে ক্ষমতায় আসে। দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ যে কাজ করেছে তার ফলে জনগণ আমাদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে। আমাদের ভোট নিয়ে নির্বাচিত করেছে। কিন্তু সেই ভোট ঠেকানোর নামে মানুষ পোড়ানো থেকে শুরু করে বিএনপি-জামায়াত যা করেছে, সেটা দেশের মানুষ ভুলে যায় কিভাবে? একেকটা নির্বাচনে আগে তারা অত্যাচার নির্যাতন করেছে। বলেছে- নির্বাচন করবে না। তারা দেখাতে চেয়েছে- তারা অংশ নেয়নি তাই নির্বাচন হয়নি। এটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, হাইকোর্টের একটা রায় আছে, সেখানে- সংবিধান লঙ্ঘন করে মার্শাল ল’ জারি করে যারা ক্ষমতা দখল করেছে, সেটাকে অবৈধ বলা হয়েছে। জিয়াউর রহমান শুধু মার্শাল ল’ নয়, আর্মি রুলস সেটাও ভঙ্গ করেছিল। কারণ সেখানে স্পষ্ট লেখা ছিল- সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তারা নির্বাচন করতে পারবে না বা কোন রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু জিয়াউর রহমান একাধারে সেনাপ্রধান, সেই সঙ্গে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয়। পরে আবার ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। এরপর আবার রাজনৈতিক দল গঠন করে। সেই দলই হচ্ছে বিএনপি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের হাতে গড়া দল হচ্ছে এই বিএনপি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশ লক্ষ্যচ্যুত হয়েছিল। পঁচাত্তরের পরে দেশে ১৯টা সামরিক ক্যু হয়। এর ফলে সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কোর্ট মার্শাল হয়েছে, ফায়ারিং কোয়ার্ড হয়েছে এবং ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কয়েকদিন আগেও বহু স্বজনহারা মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের স্বজন হত্যার বিচার চেয়েছে। তারা লাশও খুঁজে পায়নি। লাশও গুম করে দেয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই এ ঘটনাগুলো ঘটায়। কাজেই তাদের সেই দাবির একটা তদন্ত হোক। কেন তারা স্বজনদের লাশগুলো পেল না?
শেখ হাসিনা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর আমি এবং রেহেনা দেশে আসতে পারিনি। আমাদের রিফিউজির মতো থাকতে হয়েছে। ১৯৮১ সালে যখন আমাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, তখন অনেক বাধা ছিল, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশে ফিরে আসব। এরপর আমি চেষ্টা করেছিলাম সংগঠনগুলো গড়ে তোলার। এসময় পঁচাত্তর-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে জাতির পিতার খুনীদের বিচার না করে তাদের পুরস্কৃত করা ও বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া, নির্বাচনী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেয়া এবং সংসদে বসার সুযোগ করে দেয়ার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।