স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ

2

ড. সুলতান মাহমুদ রানা :

সারা দেশে ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। বিএনপি ভোট বর্জন করায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপক্ষে দলের নেতাকর্মীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বেশির ভাগ ইউনিয়নে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত, দলের সুবিধা নিচ্ছেন অথচ দলের সিদ্ধান্ত না মেনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোট করছেন এমন পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে বেশ কিছু ইউনিয়নে বিতর্কিতরা নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় এ বিষয়ে দলের তৃণমূল পর্যায়ে অসন্তোষ ও ক্ষোভ লক্ষ করা যাচ্ছে। দলের মনোনয়ন চেয়ে পাননি এমন অনেক প্রার্থী বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে নামছেন। বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় এই প্রবণতা এবার অনেক বেশি।
দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় অনেকের অর্থবিত্তের পরিমাণ বাড়ায় অনেকেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চান। এখন যাঁরা অর্থবিত্ত কিংবা সম্পদশালী তাঁদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের কেউ কেউ মনোনয়ন বাগিয়ে নিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণত লক্ষ করা যাচ্ছে যে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা ইউনিয়নে প্রভাব বিস্তার করার জন্য নানা মেকানিজম করে থাকেন। এসব প্রভাবশালী ব্যক্তি দলের প্রার্থীকে পছন্দ না হলে অন্যজনকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থী যেখানে পাননি সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে প্রকৃত আওয়ামী লীগার যাঁরা, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে মনোনয়ন পাচ্ছেন না আবার মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারছেন না। বিদ্রোহীরা নানা কৌশলে অর্থের প্রভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে উঠছেন। নৌকা প্রতীকের বিপরীতে অন্য কোনো প্রতীক বিজয়ী হওয়ার এই প্রবণতা দলের জন্য কতটুকু ভারসাম্যপূর্ণ সেটি ভাবনার বিষয়।
কারণ দর্শানোর নোটিশ, বহিষ্কার, ভবিষ্যতে দলীয় পদ-পদবি এবং মনোনয়ন না পাওয়া, দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে কোনো নোটিশ ছাড়াই দল থেকে বহিষ্কার, তৃণমূল থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে কেন্দ্রে নাম পাঠানো এত সব উদ্যোগ নিয়েও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমন করতে পারছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সবার মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, কেন্দ্রে নাম পাঠানোর সময় স্বজনপ্রীতি, স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং, লবিং, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনের মাঠে না থাকা এবং দলের চেইন অব কমান্ডের অভাবের কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এবং এগুলোই বিদ্রোহী প্রার্থী না ঠেকাতে পারার কারণ বলে মনে করা যায়।
বিগত কয়েক বছর ধরে দলের হাইকমান্ড থেকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে যে দল বিদ্রোহীদের শক্ত হাতে দমন করবে। বিদ্রোহীরা দলে কোনো পদ পাবেন না। তাঁদের ভবিষ্যতে মনোনয়নও দেওয়া হবে না। তবে নিশ্চিতভাবেই এসব সতর্কবাণী মোটেও কোনো কাজে আসছে না। কারণ এর আগে এমন সতর্কবাণী থাকা সত্ত্বেও দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে তাঁদের দলে আবার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। দলীয় পদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি মনোনয়নও দেওয়া হয়েছে। সংগত কারণে এখনো ওই সব বিদ্রোহী প্রার্থী মনে করেন যে বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচনে ভালো ফল করতে পারলে দলে আবার ভালো মর্যাদা পাওয়া যাবে। তা ছাড়া দলে যাঁরা অনুপ্রবেশকারী এবং নব্য আওয়ামী লীগার তাঁদের কাছে দলের ভাবমূর্তি এবং পরবর্তী সময়ে তাঁদের দলে মর্যাদা পাওয়ার বিষয়টি অতটা গুরুত্বপূর্ণ থাকে না।
ইদানীং আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, মনোনয়নপ্রাপ্ত ও বিদ্রোহী উভয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান প্রার্থীরা দলের প্রভাবশালী নেতাদের কাছে আসছেন এবং বলছেন, শুধু সংশ্লিষ্ট থানায় ফোন করে বলে দিতে যেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, তাহলেই তিনি জিততে পারবেন। এমনকি এসব বিদ্রোহী প্রার্থীর মূল শ্লোগান হলো নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ হলে তাঁদের বিজয় নিশ্চিত। আর এমন দাবি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। বিশেষ করে মাঠে বিএনপি না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ এমন প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চোখে পড়ার মতো আকার ধারণ করেছে।
রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতার পাশাপাশি অবস্থান করায় শক্ত প্রতিপক্ষ ক্রমেই দুর্বল হওয়ায় নিজের দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও কোন্দলের মাত্রাও বেড়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে একই ব্যক্তি বারবার সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় এবং দলের অন্যান্য নিবেদিতরা বঞ্চিত হওয়ায় এ ধরনের প্রতিযোগিতার মাত্রা বেড়েছে। জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ অঙ্গসংগঠনগুলোতেও এমন প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা যায়, যেসব আওয়ামী লীগার নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোট করছেন, তাঁরা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও আদর্শ ধারণ করেন না। তাঁদের অনেকেই অনুপ্রবেশকারী। ওই সব অনুপ্রবেশকারী পুরনো রাজনৈতিক আদর্শ মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। তাঁদের দ্বারাই নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে, যার দায়ভার আওয়ামী লীগের ওপরই পড়ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারীরাই সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন মূল দলের নিবেদিতদের তুলনায়। এসব কারণে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশে কিছুটা উদ্বেগ-উত্তেজনা, ক্ষোভ এবং নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সূত্রপাত হয়েছে। সরকারের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই এমন পরিস্থিতির সূত্রপাত এবং তা মোকাবেলা করার বিষয়ে চিন্তার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এ কথা বলার অবকাশ নেই যে সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে রয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি, কার্যক্রম এবং অর্জন আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি প্রমাণ করছে বারবার। তবে একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, অন্যদিকে নিজেদের যথাযথভাবে মজবুত করতে না পারার দীর্ঘশ্বাসও দীর্ঘ হচ্ছে। দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সচেতন মহলকেও যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। সংগত কারণেই আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কা তৈরি করেছে। এ জন্য এই মুহূর্তে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি অটুট রাখতে দলের ভেতর থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি এবং চেইন অব কমান্ড অক্ষুণ্ন ও মজবুত রেখে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আগামীর পথচলার ক্ষেত্র সুপ্রসন্ন রাখতে না পারলে নিজেরাই নিজেদের শক্ত বাধা হিসেবে সামনে আসবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।