ডলারের দাম বাড়ছে, আমদানির চাপ

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। এতে প্রতিদিনই মান হারাচ্ছে টাকা। রবিবারও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ১০ পয়সা। এর মানে একদিনের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ১০ পয়সা বেড়ে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ৫৭ পয়সায় উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ৮৫ টাকা ৫৭ পয়সা। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হলেও দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এদিকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাবে খোলাবাজারে চড়েছে ডলারের দাম। খোলাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে এখন খরচ হচ্ছে ৮৯ টাকা। সাধারণত ডলারের দাম বাড়লে রেমিটার ও রফতানিকারকরা লাভবান হন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হন আমদানিকারক ও সাধারণ মানুষ। কারণ ডলারের দাম বাড়লে পণ্যমূল্যও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি আয়ে ধীরগতি ও রেমিটেন্সপ্রবাহের নিম্নমুখিতার মধ্যে আমদানিতে গতি আসায় অনেক ব্যাংকে দেখা দিয়েছে ডলারের সঙ্কট। ফলে কিছুদিন ধরে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে ডলারের দাম।
করোনা মহামারীর মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। গত ৫ আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। এখন প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে দাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। রবিবার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা ৫৭ পয়সায়। এর মানে দুই মাসেরও কম সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকা ৭৭ পয়সা দর হারিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার আতঙ্ক কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আমদানি বেশ বাড়ছে। আবার বিলম্বে পরিশোধ শর্তে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়েছিল, সেগুলোর এখন পেমেন্ট করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। এতে দামও বাড়ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলার রিজার্ভ রয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের কাছে ডলার কিনতে পারে কারণ আমাদের ডলারের ঘাটতি নেই।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানি বাড়ায় ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে প্রচুর রেমিটেন্স আসায় ডলারের সরবরাহ বেড়ে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে তেমনটি থাকবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স বাড়েনি। গত আগষ্ট মাসেও আগের তুলনায় কমেছে। সেপ্টেম্বরেও কমেছে। অন্যদিকে আমদানি অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘সবমিলিয়ে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর চাহিদা বাড়লে যে কোন পণ্যের দাম যেমন বাড়ে; ডলারের দামও তেমনি বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। আর এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম বাড়ার সুযোগ করে দিয়ে ঠিক কাজটিই করছে বলে আমি মনে করি। ‘এর ফলে রফতানি খাতের ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টাকার মান বেড়ে গেলে অর্থনীতির এই দুই সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।’
সঙ্কট সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রি : বাজার স্থিতিশীল করতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে ১-২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে ৩২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর গত আগস্ট মাসের পুরো সময়ে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের ১ জালাই থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে ৭৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। মহামারীর শুরুর দিকে প্রবাস আয়ে যে চাঙ্গা ভাব ছিল, চলতি বছরের জুন থেকে তা নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত আগস্ট মাসে প্রবাসীরা ১৮১ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। গত বছরের আগষ্টে রেমিটেন্স এসেছিল ১৯৬ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত বছরের চেয়ে এবার আগস্টে রেমিটেন্স কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। একইভাবে রফতানি আয়েও চলছে ধীরগতি। গত জুলাই-আগস্টে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয় কমেছে দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে আমদানি ব্যয়ের গতি বেশ চাঙ্গা। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাই মাসে আমদানি বাবদ ৪২২ কোটি ডলার খরচ হয়। চলতি বছরের জুলাইয়ে খরচের এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১৪ কোটি ডলার। এই হিসাবে আমদানি খরচ বেড়েছে ২১.৬০ শতাংশ।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো চাইলেও বাড়তি ডলার নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে রাখতে পারে। এর অতিরিক্ত হলেই তাকে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হবে। কেউ নির্ধারিত সীমার বাইরে ডলার নিজেদের কাছে রাখলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়। জরিমানার হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।
খোলাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে এখন খরচ হচ্ছে ৮৯ টাকা : করোনার প্রাদুর্ভাবের পর বিদেশী পর্যটক ও যাত্রীদের আসা-যাওয়া সীমিত হয়ে যাওয়ায় খোলাবাজারে নগদ ডলারের সরবরাহ দীর্ঘদিন ধরেই তুলনামূলক কম ছিল। এখন লকডাউন উঠে যাওয়ায় বিদেশী পর্যটক ও যাত্রীদের আসা-যাওয়া কিছুটা শুরু হয়েছে, তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম। অন্যদিকে করোনার মধ্যেই চিকিৎসাসহ জরুরী প্রয়োজনে অনেকেই দেশের বাইরে যাচ্ছে। ফলে তারা খোলাবাজার থেকেই নগদ ডলার সংগ্রহ করছে। এতে খোলাবাজারে ব্যাপক চড়েছে ডলারের দাম। রবিবার খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ৮৯ টাকায়। এর মানে এখন খোলাবাজারের সঙ্গে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দামের পার্থক্য সাড়ে তিন টাকা ছাড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে এই পার্থক্য থাকে দেড় থেকে দুই টাকার মধ্যে। মূলত সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকায় খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
রফতানিকারকরা খুশি : টাকা অবমূল্যায়িত হওয়ায় খুশি দেশের রফতানিকারকেরা। কারণ এতে আগের তুলনায় বেশি আয় হচ্ছে তাদের। কিন্তু এই রফতানিকারকদের একটি অংশ যেখানে আমদানিকারক, সেই দিক থেকে তারা আবার নাখোশও। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, বাংলাদেশে রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি হচ্ছে। আবার প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। তাই টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় খুব বেশি লাভবান হতে পারছেন না এসব ব্যবসায়ী। আর রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকা আরও খানিকটা অবমূল্যায়ন হলে করোনার এই কঠিন সময়ে রফতানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হতো। তিনি বলেন, ‘আমরা আমদানি-রফতানি দুটিই করি ডলারে। রফতানির পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে একটু একটু করে ডলারের দাম বাড়লে আমাদের উপকার হয়। প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও ভারত ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার অনেক অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে বলে উদাহরণ দেন ফারুক।