নতুন আতঙ্ক রিমান্ড, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দীর্ঘ ২৩ বছর পর রিমান্ড আবার আলোচনায় ফিরে এসেছে। ১৯৯৮ সালে রিমান্ডে রুবেল নিহত হওয়ার পর নায়িকা পরীমনির রিমান্ডকে কেন্দ্র করে বিষয়টি ফের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এই দীর্ঘ সময় রিমান্ডে অনেক ঘটনা ঘটেছে। কোন কোনটি আলোচনায় এসেছে, অনেক রিমান্ডের ঘটনা চাপা পড়ে গেছে। তবে বিষয়টি উচ্চ আদালতের দৃষ্টি এড়ায়নি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিলেও পুলিশ তা মানছে না। ফলে রিমান্ড এখন এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের নামই রিমান্ড। কিন্ত রিমান্ডে নিয়ে কি হয় তা ছোট বড় সবাই বুঝে। মামলা করার পর যেখানে প্রয়োজন সেখানেও যেমন রিমান্ড চাওয়া হচ্ছে, আবার যেখানে প্রয়োজন নয়, সেখানেও নিম্ন আদালতের অনুমতি নিয়ে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনায়ও এখন রিমান্ডে নেয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রিমান্ডে নেয়ার পর মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। কিন্তু নাগরিকদের গ্রেফতারের পর রিমান্ড অর্থাৎ ১৬৭ ধারার বিধান অনুসরণ হচ্ছে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার ক্ষমতাবলে যখন তখন রিমান্ড চাওয়া ও মঞ্জুর করা স্বাধীনতার চেতনা ও সংবিধান পরিপন্থী। রিমান্ডে নেয়ার যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি রিমান্ড নিয়ে উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করাও ঠিক নয় বলে আইন বিশেষজ্ঞগণ অভিমত প্রকাশ করেছেন।
এ সময়ের আলোচিত নায়িকা পরীমনিকে একাধিকবার রিমান্ডে নেয়ার ঘটনার পর উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানোর ঘটনায় দুই বিচারক দেবব্রত বিশ্বাস ও আতিকুল ইসলামের দেয়া ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি উচ্চ আদালত। ফলে বুধবার ফের লিখিত ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ২৪ অক্টোবরের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়েছে। এর আগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানো নিম্ন আদালতের দুই বিচারকের দাখিল করা ব্যাখ্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, লিখিত ব্যাখ্যায় তারা হাইকোর্টকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নই। বিচারকদের ব্যাখ্যায় হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন (হেয়) করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আদালত। ওইদিন পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানো দুই বিচারক দেবব্রত বিশ্বাস ও আতিকুল ইসলাম আদালতের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। গত ২ সেপ্টেম্বর চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুরের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিচারকদের কাছে ব্যাখ্যা চান হাইকোর্ট। এ সময় পরীমনির মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকেও তলব করেন হাইকোর্ট।
পরীমনির রিমান্ডের বিষয়ে তার আইনজীবী বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় যে বিধান আছে এবং আপীল বিভাগের যে গাইডলাইন আছে, সেগুলো পরীমনির রিমান্ডের ক্ষেত্রে ‘অনুসরণ করা হয়নি’। অন্যদিকে পরীমনির তিন দফা রিমান্ডের বিষয়ে হাইকোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হাইকোর্ট বলেছেন, পুলিশ বিভাগের বোঝা উচিত মানুষের জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। আইনী ভিত্তি ছাড়া পুলিশ রিমান্ড চাইতে পারে না।
জানা যায়, ৫ বছর আগে আটক ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে মেডিক্যাল প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আপীল বিভাগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বতপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নিতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। দুই ধারা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপীল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসেছে কিছু নীতিমালা। এদিকে রিমান্ড বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞগণ পক্ষে-বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন , জঙ্গী, মাফিয়া ডন, দাগী আসামিদের গ্রেফতার ও তাদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও ১৬৭ ধারার জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি ক্ষেত্র বিশেষ রাখা প্রয়োজন। এখন বড় বড় অপরাধীকে জিজ্ঞাসাবাদের ফলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। তবে যত্রতত্র এই ক্ষমতা ব্যবহার করাটা ঠিক হবে না। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন, জেলহত্যা মামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যদি আসামিদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ না করা হতো, তা হলে তথ্য পাওয়া যেত না।
সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছেন, সংবিধান অনুসারেই তো আদালতে রায় দেয়া হয়েছিল। কে কার কথা শুনে। রায় না শুনলে কি করার আছে? আলোচনা পরীমনি নিয়ে আসবে কেন। এর আগে আরও অনেক ঘটনায় আসা উচিত ছিল। সেখানে আসে নাই। সেখানে পরীমনি নায়িকা দেখেই তার কথাটা আসছে। এর আগে পিয়াসাসহ অনেককেই ধরেছে। রিমান্ডে নিয়েছে তাদের বিষয়ে তো কথা আসেনি। রায়টা দেয়া হয়েছিল কিন্ত রায়টা মানছে না কেউ। সরকার যদি রায় মানার বিষয়ে উদ্যোগ না নেয় বা ইচ্ছা প্রকাশ না করে তা হলে বাংলাদেশের বহু রায় তো কাগুজে রায় হয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে একটাই বিকল্প ছিল রায়টাকে কাগজের রায় হিসেবে যাতে কেউ না দেখে। সে বিষয়ে একটা ক্ষমতা আছে কোর্টের। কোর্ট তা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করছে না। যে ক্ষমতার মাধ্যমে রায় বাস্তবায়ন হবে সেই ক্ষমতাটা পুরোপুরি ব্যবহার করছে না। যার ফলে রায় অনেক সময় হয়, অনেকেই এটা পাত্তা দিতে চায় না। ফলে রায় না মানলে কিছু হবে না মানুষের মনে এমনভাব ঢুকে গেছে। এ জন্য রায় মানামানি তেমন একটা দেখা যায় না। এখানে রায় এ রিমান্ডের বিষয়টি দেখবে পুলিশ প্রশাসন। রিমান্ড তারাই চায় তারাই ধরে। আরেকটা হলো নিম্ন আদালত। এ দু জায়গাতেই তারা মানছে না। পুলিশ প্রশাসনকে রায় মানার জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে অহেতুক রিমান্ড না চায়, যুক্তি ছাড়া যেন রিমান্ড না চায়। রিমান্ড যেন আদালতের নির্দেশমতো হয়। এটা সরকারের দায়িত্ব। আর নিম্ন আদালত রিমান্ড চাইলেই দিয়ে দিল। যে ক্ষেত্রে দেয়ার কথা না সেখানেও দিয়ে দিল। তাদের তো একটু আইন অনুসারে আদালতের নির্দেশ অনুসরণ করা উচিত।
পরীমনির আইনজীবী মুজিবুর রহমান বলেন, রিমান্ডে নেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের গাইডলাইন মানতে হবে। আইনে রিমান্ডের কথা বলা আছে। রিমান্ডে নেয়ার উদ্দেশ্য মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য। তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটনের জন্য রিমান্ড প্রয়োজন। রিমান্ডের বিষয় এই না তাকে নিয়ে টর্চার করা। রিমান্ডের উদ্দেশ্যই হলো কোন মামলার ক্লু উদ্ঘাটন করা। আমাদের সমাজে যেটা হচ্ছে রিমান্ডের নামে যাকে ইচ্ছা তাকেই রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। আমাদের নিম্ন আদালত আছে। ওনারাও অনেক সময় দেখা যায় ভালভাবে না দেখে পুলিশের কথায় তারা সেগুলো মঞ্জুর করে দিচ্ছেন। এ বিষয়গুলো সংশোধন হওয়া দরকার বলে মনে করি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার ক্ষমতাবলে যখন তখন রিমান্ড চাওয়া ও মঞ্জুর করা স্বাধীনতার চেতনা ও সংবিধান পরিপন্থী। বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধিতে রিমান্ড শব্দটি নেই; তারপরও পুলিশ বিচার বিভাগের অনুমতি নিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার অধীনে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে থাকে। রিমান্ড নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান এবং ফৌজদারি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করা হয়। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে রিমান্ডে নিয়ে যে তথ্য বা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী পুলিশ গ্রহণ করে তার কিন্তু কোন বিচারিক মূল্য নেই। এই নীতি জানার পরেও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চলছে। ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগ একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করে ১৫টি নির্দেশনা প্রদান করেন। পরবর্তীতে এই নির্দেশনাগুলো বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট-এর আপীল বিভাগ বহাল রাখেন। এখন প্রতিটি ফৌজদারি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে এই নীতিমালাগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই নির্দেশনাগুলো পুলিশ মানছে না এবং না মানার জন্য পুলিশ বিভাগের কোন অনুতাপ নেই। কখনও শুনিনি যে, পুলিশ এই নির্দেশনাগুলো মানার জন্য কোন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে খারাপ লাগে যখন দেখতে পাই যে, মানবাধিকার কমিশন এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে।
এ ছাড়া সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ৩ এ বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন। ৫ এ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাইবে না। কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’
উচ্চ আদালতে রায় : ১৯৯৮ সালে দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছিল ডিবি হেফাজতে নিহত ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল হত্যাকাণ্ডটি। ওই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ৫৪ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্ট। বিচারপতি মোঃ হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ৫৪ ধারায় আটকের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালের ২৪ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চে অন্য বিচারপতি ছিলেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। ২০১৬ সালের ১০ নবেম্বর বেশ কিছু গাইডলাইন দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই দুটি ধারা নিয়ে আপীল বিভাগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের প্রতি মোট ১৯ দফা গাইডলাইন (নির্দেশনা) দিয়েছেন। এর মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি ১০ দফা আর ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের প্রতি ৯ দফা গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। কিছু গাইডলাইন আছে আসামিদের সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করা যাবে, সে বিষয়েও।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য : ১. মানুষের জীবন যেহেতু সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, সেহেতু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। ২. উঁচুমানের পেশাগত দায়িত্বশীলতা দিয়ে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা মানুষকে সুরক্ষা ও কমিউনিটিকে সেবা দেবে; নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তারা পালন করবে আইন মেনে। ৩. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রাথমিক চেষ্টা থাকবে অপরাধের পথ বন্ধ করার দিকে। একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর সক্রিয় হওয়ার চেয়ে আগেই তা প্রতিহত করা উত্তম। ৪. আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কেউ নিষ্ঠুর-অমানবিক-মর্যাদাহানিকর কোন আচরণ, নির্যাতন বা শাস্তি প্রদান অথবা তাতে উস্কানি দেয়ার ঘটনা সহ্য করবে না। ৫. দায়িত্ব পালনকালে তারা মানুষের মর্যাদা রক্ষা ও সম্মান করবেন এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখবেন। ৬. অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কেবল দায়িত্ব পালনে আবশ্যক হলেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করবে। ৭. সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকারের প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেবল সম্মানই দেখাবে না, তা মেনেও চলবে।
গ্রেফতার-হেফাজত নীতিমালা : কোন ব্যক্তিকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার ফরওয়ার্ডিং লেটারে ব্যাখ্যা করবেন- কেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার পক্ষে তদন্ত শেষ করা সম্ভব না। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগকে কেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে, তাও উল্লেখ করতে হবে। ২. কাউকে গ্রেফতারের পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি নথি তৈরি করবেন, যেখানে গ্রেফতারের স্থান, সময় ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষর থাকবে। ৩. গ্রেফতারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা গ্রেফতার ব্যক্তির স্বজনকে জানাতে হবে। স্বজনদের কাউকে না পেলে ব্যক্তির নির্দেশনা অনুসারে তার বন্ধুকে জানাতে হবে। আর তা করতে হবে ১২ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই। ৪. বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক রাখার জন্য কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না। ৫. কাউকে গ্রেফতারের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অবশ্যই তার পরিচয় জানাতে হবে। প্রয়োজনে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। ৬. গ্রেফতার ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন থাকলে চিকিৎসার জন্য তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছ থেকে সনদ নিতে হবে। ৭. ব্যক্তিকে যদি তার বাসা বা কর্মক্ষেত্রের বাইরে অন্য কোথাও থেকে গ্রেফতার করা হয়, সেক্ষেত্রে থানায় নেয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টি তার স্বজনদের লিখিতভাবে জানাতে হবে। ৮. গ্রেফতার ব্যক্তি চাইলে যে কোন স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাত বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ পাবেন। ৯. কোন যুক্তিতে, কার তথ্যে বা অভিযোগে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ঠিকানাসহ তা কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে। আটক ব্যক্তি কোন কর্মকর্তার তদারকিতে রয়েছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে। ১০. গ্রেফতারের পর কাউকে রিমান্ডে নিতে হলে আগে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা দায়ের করতে হবে।
বিচারকদের জন্য গাইডলাইন : রিমান্ডের বিষয়ে উচ্চ আদালত বিচারকদের জন্য নয়টি গাইডলাইন দিয়েছেন। এগুলো হলো- ১. মেডিক্যাল প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে নির্যাতনের ফলে হেফাজতে মৃত্যু বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হলে বিচারক স্বতপ্রণোদিত হয়ে অপরাধ আমলে নেবেন; মামলা দায়েরের অপেক্ষা করবেন না। ২. উপরোক্ত শর্ত অনুসারে গ্রেফতার ব্যক্তিকে আটকের পর ১৫ দিনে মামলার তদন্ত শেষ না হলে এবং মামলাটি যদি কেবল দায়রা আদালত বা ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যক্তিকে ৩৪৪ ধারা অনুসারে রিমান্ডে পাঠানো যাবে, যা একবারে ১৫ দিনের বেশি হবে না। ৩. ফরওয়ার্ডিং লেটার এবং মামলার ডায়েরিতে কোন ব্যক্তিকে আটক রাখার জন্য সন্তোষজনক কারণ পাওয়া গেলে বিচারক পরবর্তী বিচারিক পদক্ষেপের আগ পর্যন্ত তাকে আটক রাখার আদেশ দিতে পারেন।
৪. সম্ভাব্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য আটক করা হয়েছে- এমন সন্দেহভাজন কাউকে বিচারিক হেফাজতে পাঠানোর আবেদন বিচারক মঞ্জুর করবেন না। ৫. ১৬৭ ধারায় আটক ব্যক্তিকে কোন আদালতে হাজির করা হলে শর্তগুলো পূরণ হয়েছে কিনা, তা দেখা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের দায়িত্ব। ৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যদি আইনের বাইরে গিয়ে কাউকে আটক করে থাকেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট দণ্ডবিধির ২২০ ধারায় তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন। ৭. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (২) ধারা অনুসারে ডায়েরির অনুলিপি ছাড়া কাউকে আদালতে হাজির করে আটকাদেশ চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত, ট্রাইব্যুনাল একটি বন্ড গ্রহণ করে তাকে ক্ত দিয়ে দেবে। ৮. আটক থাকা কোন ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্য কোন সুনির্দিষ্ট মামলায় যদি গ্রেফতার দেখাতে চায়, সেক্ষেত্রে যদি ডায়েরির অনুলিপিসহ তাকে হাজির না করা হয়, তাহলে আদালত তা মঞ্জুর করবেন না। গ্রেফতার দেখানোর আবেদনের ভিত্তি না থাকলে বিচারক আবেদন খারিজ করে দেবেন। ৯. হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে বিচারক মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে মৃত ব্যক্তিকে পরীক্ষা করবেন। এমনকি দাফন হয়ে গেলেও লাশ তুলে তা করতে হবে। নিপীড়নে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুসারে ওই কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কমান্ডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিতে হবে।