শিক্ষার্থীদের কলতানে কাল সরব হবে শিক্ষাঙ্গন, চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
এই আনন্দের বুঝি কোন ব্যাখ্যা নেই। এই উচ্ছ্বাস প্রকাশের বুঝি কোন ভাষা নেই। আর মাত্র একদিন। এরপরই শিক্ষার্থীদের পদচারণায় আবার সরব হবে শিক্ষাঙ্গন। দীর্ঘ পৌনে দুই বছর পর প্রিয় আঙ্গিনায় ফিরতে উন্মুখ যেন সবাই। তাদেরকে বরণ করে নিতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। টানা বন্ধের কারণে বেশিরভাগ স্কুলেই জমেছে ঝোপঝাড়। সেগুলো কেটে করা হচ্ছে সাফসুতোর। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে যেমন নেয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা তেমনি ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণে ছিটানো হচ্ছে মশার ওষুধ। শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে একচুল ছাড় দিতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাস মহামারীতে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাসে বসতে যাচ্ছে দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে শুরুতে সব শ্রেণীর ক্লাস প্রতিদিন হবে না। শুধু পঞ্চম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর ক্লাস প্রতিদিন হবে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীতে সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ মাস্ক ছাড়া ঢুকতে পারবে না। এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। শিক্ষক, কর্মচারী, অভিভাবকসহ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক ছাড়া কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসবে না এবং সবার মাস্ক পরতে হবে। ছোট বয়সী শিক্ষার্থীর খেয়াল রাখতে হবে, যেন মাস্কে কোন সমস্যা না হয়। বাসায় কেউ অসুস্থ থাকলে সেই বাসার শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না পাঠানোর পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, বাসায় কেউ অসুস্থ হলে স্কুলে পাঠাবেন না। শিক্ষকরা নিশ্চিত করবেন তাপমাত্রা ও উপসর্গ চেক করা। প্রতিটি স্কুল নজরদারি করা হবে এবং সংক্রমণ বাড়ার কারণ আছে মনে হলে প্রয়োজন হলে তা বন্ধ করা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ এখন হবে না। তবে সীমিত পরিসরে খেলাধূলা চলতে যেন পারে, সে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণগুলোতে জমেছে ঝোপঝাড়, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। রাজধানীতে এসব পরিষ্কারে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়েছে জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘শিক্ষার জন্য সুস্থ পরিবেশ’ বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিন দিনব্যাপী বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সরকারী, বেসরকারী ও আধাসরকারী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ মোট ৪৪৩টি প্রতিষ্ঠানে ৮, ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর ৩ দিনব্যাপী বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯ এর গণটিকা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোতে ১১ সেপ্টেম্বর বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে জানান তিনি। মেয়র বলেন, এ সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটা ক্লাসরুমে ফগিং ও স্প্রে করা, খেলার মাঠ ও ছাদসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর টয়লেট কিংবা অন্য কোথাও পানি জমে থাকলে সেখানে লার্ভিসাইডিং করা হবে। ডিএনসিসির মেয়র বলেন, শিক্ষার্থীদের সুস্থ ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ খুবই জরুরী। তাই প্রত্যেকটি বাসাবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন।
এদিকে সরেজমিনে দেখা যায়, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় মতিঝিল টিএ্যান্ডটি স্কুলের খেলার মাঠে শিক্ষার্থীদের পদচারণা না থাকায় বড় হয়েছে ঘাস। মেশিন দিয়ে এসব কাটছেন এক পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তিনি বলেন, শুধু ঘাস নয় এখানে সেখানে বড় হয়ে থাকা ঝোপঝাড়ও দুই দিন যাবত কেটে পরিষ্কার করছি কয়েকজন মিলে। যেন স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারে।
তবে প্রথমেই সব শিক্ষার্থীর প্রতিদিন ক্লাস করতে হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি জানান, প্রথম ক্লাস শুরু হবে ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং যারা আগামী বছর এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা দেবে, তারা প্রতিদিন ক্লাস করবে। বাকি ক্লাসগুলো প্রাইমারীতে ওয়ান থেকে ফোর এবং ৬ থেকে ৯ম শ্রেণী সপ্তাহে একদিন ক্লাস করবে। ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস শেষ হলে সেক্ষেত্রে দশম শ্রেণী এবং একাদশ শ্রেণীর ক্লাস টানা চলবে। কোন ক্লাসে শিক্ষার্থী বেশি হলে প্রয়োজনে বিভক্ত করে ভিন্ন শ্রেণী কক্ষে নিয়ে ক্লাস নেয়া হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, শুরুতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা করে ক্লাস চলবে। তবে পর্যায়ক্রমে সময়সীমা বাড়ানো হবে। যেসব শ্রেণীর ক্লাস সপ্তাহে একদিন চলবে, তাও পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে বলে দীপু মনি জানান। তিনি বলেন, পিইসি, জেএসজি, জেডিসি পরীক্ষা এবং বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি থাকবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরীক্ষা নেয়া হবে। প্রাক প্রাথমিক স্তরের ক্লাস শুরুর বিষয়ে মন্ত্রী কিছু বলেননি।
তবে যেভাবেই হউক স্কুল-কলেজ তো খুলছে। তাই উচ্ছ্বাস দীর্ঘদিন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পা না ফেলতে পারা শিশু রাইসার কণ্ঠে। জীবনের জটিল হিসাব এখনও বুঝে উঠতে না পারলেও স্কুলে গেলে যে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারবে তাতেই খুশি সেই। আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ফোন করে বলছে স্কুল খোলার প্রথম দিন সে কোন কোন বন্ধুর সঙ্গে খেলবে। দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধ থাকায় ঘরবন্দী জয়ীতার উচ্ছ্বাসটা একটু বেশি। এইচএসসি পরীক্ষার্থী জয়ীতা বলেন, পুরো কলেজ জীবনটাই মিস করে গেলাম করোনার কারণে। এখন তাও যদি কিছুদিন ক্লাস হয় তাহলে কিছুটা কলেজ সময় উপভোগ করতে পারব। নয়ত সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। উচ্ছসিত নবম শ্রেণীর ছাত্রী তাথৈও। রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুলের এই ছাত্রী বলেন, বাসার এত কাছে আমার স্কুল। কিন্তু বন্ধ থাকায় দেড়টা বছর স্কুলের মাঠে পা দেইনি। কাল থেকে আবার খেলব স্কুলের খেলার মাঠে। কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উচ্ছসিত অভিভাবকরাও। তবে সন্তানদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রয়েছে কিছুটা উদ্বেগ। রাজধানীর এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজের ছাত্রী অহনা আনজুমের মা শাহনাজ শারমীন বলেন, স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হউক সেটা আমরা চেয়েছিলাম। বাচ্চারা অন্তত কিছুটা ভাল সময় কাটাতে পারবে। তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর হতে হবে কর্তৃপক্ষকে। একটি সন্তানও যেন কোন ধরনের স্বাস্থ্য হুমকিতে না পড়ে সে বিষয়টির খেয়াল রাখতে হবে।