দেশের ইতিহাস আর কেউ কোনো দিন বিকৃত করতে পারবে না – প্রধানমন্ত্রী

4
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সচিবালয় প্রান্তে যুক্ত হয়ে মন্ত্রী পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর দেশের ইতিহাস একেবারেই মুছে ফেলা হয়েছিল, পুরো পরিবর্তন। এখন একটা আত্মবিশ্বাস এসে গেছে যে, বাংলাদেশের ইতিহাস আর কেউ কোনোদিন বিকৃত করতে পারবে না, আর মুছতে পারবে না। অনেক ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়ে বাংলাদেশ যেখানে পৌঁছেছে, সেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর প্রায় ৬ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরার দিনটি স্মরণ করে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের শুরুতে প্রদত্ত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আল্লাহ সবসময় সহযোগিতা করে এবং আল্লাহ কিছু কাজ দেয় মানুষকে। সে কাজটা যতক্ষণ শেষ না হয় ততক্ষণ কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করে। একটা প্রতিজ্ঞ আমার আর রেহানার (বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা) ছিল যে, স্বাধীনতা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না, স্বাধীনতাকে সফল করতেই হবে।
গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দেন। সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের চার দশক পূর্তি উপলক্ষে সরকারপ্রধানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘আপনি (প্রধানমন্ত্রী) এদিন দেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ আপনার হাত ধরেই গড়ে উঠছে।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে ৪০ বছর পূর্বে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তাঁর ৬ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফেরার মুহূর্তটি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। শুধু আমাদের দেশের ভেতরে না, বাইরেও, সব কিছু মিলিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা পার হয়েই আজকে এই জায়গায় আমরা আসতে পেরেছি। এটাই সব থেকে বড় কথা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশের যে উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছিল, সে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিহাস একেবারেই মুছে ফেলা হয়েছিল, পুরো পরিবর্তন। এখন একটা আত্মবিশ্বাস এসে গেছে যে বাংলাদেশের ইতিহাস আর কেউ কোনো দিন বিকৃত করতে পারবে না। আর মুছতে পারবে না।
দেশে প্রত্যাবর্তনের সেদিনের কথা স্মরণ করে দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী, যিনি একটানা গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাই হোক, এইটুকু বলতে পারি যে, আল্লাহ সব সময় সহযোগিতা করেন এবং আল্লাহ কিছু কাজ দেন মানুষকে। সেই কাজটা যতক্ষণ শেষ না হয়, ততক্ষণ কিন্তু আল্লাহই রক্ষা করেন।
জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যারা অবৈধভাবে সরকারে এসেছিল, তারা তাঁর দেশে ফেরায় পথে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, এই বাংলাদেশ স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীন থাকবে এবং আমার বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব। অনেক ঝড়-ঝাপ্টা, বাধা অতিক্রম করেই আমাকে দেশে আসতে হয়েছিল। কারণ অনেক বাধা ছিল। তখনকার সরকার কিছুতেই আমাকে আসতে দেবে না। আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র, অনেক চিঠিপত্র পাঠানো, বিভ্রান্ত করার চেষ্টাসহ অনেক কিছুই করা হয়েছে।
দেশে ফেরার সেই সময়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, খুনী এবং যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন, তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা ক্ষমতায়, খুনীদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে, তারা ক্ষমতায়। ওই অবস্থায় কিন্তু আমি দেশে চলে এসেছিলাম। আমি কোনকিছু চিন্তা না করিনি, আমি দেশে চলে এসেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘ব্যর্থ হতে পারে না’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে পারে না, স্বাধীনতাকে আমার সফল করতেই হবে। এমন একটা প্রতিজ্ঞা আমার আর রেহানার সবসময় ছিল, এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশে চলেও এসেছিলাম। আসার পর অনেক ঝড়-ঝাপ্টা পার হতে হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
১৯৮১ সালের ১৭ মে সেই দিনটির কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘এসেছি তো ঝড় মাথায় নিয়েই। সেদিন ৬০ মাইল বেগে ঝড় হচ্ছিল। তখন আমি ট্রাকে। আর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। এজন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আওয়ামী লীগের সেই সময়কার যারা নেতাকর্মী ছিলেন, তাঁরা আমাকে আমার অবর্তমানে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত করেছিলেন। যেটা আমি জানতাম না আসলে।’
দেশের জনগণের সেই ভালবাসার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ফেরার পর দলের নেতাকর্মী ছাড়াও এদেশের জনগণ আমার পাশে ছিলেন। আসলে জনগণের শক্তিটা হচ্ছে সব থেকে বড় শক্তি। কারণ আমি যখন বাবা, মা, ভাই, বোন সব হারিয়ে এই দেশে এসেছি, গ্রামেগঞ্জে যেখানেই গেছি, সাধারণ মানুষ, গ্রামের মানুষ, তাদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি, অনেক স্নেহ, দোয়া পেয়েছি। আমার মনে হয় ওই শক্তিটাই আমার সব থেকে বড় শক্তি ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এজন্য দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি দলের সেই সময়কার নেতাকর্মীসহ যারা সঙ্গে থেকে কাজ করেছেন তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আমার দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে সব থেকে আগে স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দেয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদের (আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী)। সে তখন ছাত্রলীগের সভাপতি। আর যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন আমির হোসেন আমু (বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য)। যুবলীগের পক্ষ থেকে তাঁরা বিবৃতি দিয়েছিলেন। আর পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে এই কথাটা তুলেছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। যদিও পরে তিনি অন্য দলে চলে যান। কিন্তু তিনিই প্রথম আমার ও শেখ রেহানার দেশে আসার বিষয়টা তুলেছিলেন।
বাংলাদেশে ফেরার পর বিভিন্ন সময় তাঁর ওপর হামলা করে তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজকে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, দেশটা আরও এগিয়ে যাবে, সেটা আশা করি। পাশাপাশি বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসে যাদেরকে আমরা হারিয়েছি, তাঁদের আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি কামনা করি।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের যেদিন হত্যা করা হয়, সে সময় বিদেশে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বিদেশে দীর্ঘ নির্বাচিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তার আগেই ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ হাসিনা ভারতের নয়াদিল্লী থেকে দেশে ফিরলে প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে সেদিন তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাখো জনতা তাঁকে স্বাগত জানায় এবং তাঁকে বরণ করে নেন।