শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি বৈঠক ॥ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এক সঙ্গে চলার অঙ্গীকার

7
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশ ও ভারত সামনের দিনগুলোতে একসঙ্গে চলার অঙ্গীকার করেছে। দুই দেশ একে অন্যকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যে কোন চ্যালেঞ্জ দুই দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করারও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করবে।
শনিবার দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভারত বাংলাদেশ যৌথ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের নতুন চ্যালেঞ্জ চলমান মহামারী কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি দুই দেশ একসঙ্গে মোকাবেলা করবে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় উৎসবও দুই দেশ একসঙ্গে উদযাপন করবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় বীরদের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে আশুগঞ্জে মেমোরিয়াল স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। উভয় প্রধানমন্ত্রী এই স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
এ সময় দুই প্রধানমন্ত্রী পানি, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, জ্বালানি, পরিবেশ, নিউক্লিয়ার জ্বালানি, বাণিজ্য ও সংযোগ উন্নয়নে সহযোগিতা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে অর্জনের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেন। বলা হয়, ভারতের অর্থায়নে বাংলাদেশে ৮টি প্যাকেজ কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি প্যাকেজ কর্মসূচির অগ্রগতি হয়েছে। তবে কোভিড-১৯ এর কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সময়ে দুই প্রধানমন্ত্রী সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্রে চিহ্নিত করতে একমত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দুই দেশের সেরা অর্জন নিয়ে যৌথ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। এতে বাংলাদেশের সেরা এবং ভারতের সেরা দিকগুলো তুলে ধরা হবে। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্ত্রী উপলক্ষে ভারত বাংলাদেশের ৫০ উদ্যোক্তাকে আমন্ত্রণ জানাবে, যেখানে দুই দেশের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবে। এ উপলক্ষে ভারত সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন করবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। শনিবার রাতে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের সফর নিয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান।
ড. মোমেন বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আসার জন্য। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর দুই দেশের মধ্যে সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। তিনি বলেন, ভারত মৈত্রী কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে করোনা ভ্যাকসিন দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এই সফরের সময় সঙ্গে করে ১২ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছেন। এজন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, যে কোন দেশের আগে বাংলাদেশ প্রথম ভারতের ভ্যাকসিন পেয়েছে। বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিন প্রদান অব্যাহত থাকবে এবং বাংলাদেশের করোনা মোকাবেলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবেন। ভারতের নীতি হচ্ছে, প্রতিবেশী আগে। বাংলাদেশকে করোনা ভ্যাকসিন প্রদানের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবারও সেটাই প্রমাণ করেছেন।
তিনি জানান, দুর্যোগ দমনে সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূরের পদক্ষেপ, দুই দেশের জাতীয় ক্যাডেট কোরের মধ্যে সহযোগিতা বিনিময়, তথ্য যোগাযোগ ও রাজশাহীতে খেলার মাঠ বিষয়ে দুই প্রকল্প বাস্তবায়নে সমঝোতা স্মারকগুলো সই হয়। এছাড়াও শিলাইদহের সংস্কারকৃত কুঠিবাড়ি, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসমাধি, ভারতের উপহার ১০৯টি এ্যাম্বুলেন্স, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল, দুটি সীমান্ত হাট উদ্বোধন এবং স্মারক ডাকটিকেটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
শনিবার বিকেল ৫টার দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসলে টাইগার গেটে তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমে তারা একান্ত বৈঠকে বসেন। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তারা। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়।
বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর দুই নেতার উপস্থিতিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও খেলাধূলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা বাড়াতে এই ৫টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। এছাড়া কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে ১০৯টি এ্যাম্বুলেন্স ও ১২ লাখ করোনা টিকা উপহার দেয়া হয়েছে। দুই দেশের প্রতিনিধিদের সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ্যাম্বুলেন্সের চাবি ও টিকা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন।
সমঝোতা স্মারকগুলো হলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, রেজিলেন্স এবং প্রশমন বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ ও ভারত। এছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়া (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক, বাণিজ্য নিয়ে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস এ্যান্ড এ্যামপ্লয়মেন্ট এ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য, কোর্সওয়ার এ্যান্ড রেফারেন্স বুক সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক এবং রাজশাহী কলেজ মাঠ এবং আশপাশের এলাকায় স্পোর্টস সুবিধা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুক্রবার ঢাকায় আসেন তিনি। সকাল ১০টা ৩২ মিনিটে মোদির নেতৃত্বে আসা ভারতের প্রতিনিধিদলকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শেখ হাসিনা মোদিকে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। মোদিকে লালগালিচা সংবর্ধনা এবং গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
ঢাকা-জলপাইগুঁড়ি ট্রেন উদ্বোধন : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেসের উদ্বোধন কর হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ট্রেনটি যৌথভাবে উদ্বোধন করে বাংলাদেশে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অংশগ্রহণ করেন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নতুন এ আন্তঃদেশীয় যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হলো। তবে শনিবার উদ্বোধন হলেও করোনা পরিস্থিতি খারাপ থাকায় আপাতত যাত্রা করছে না ট্রেনটি। দুদেশের করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে ও ভারতীয় পর্যটন ভিসা চালু হলে ট্রেনটি শিডিউল অনুযায়ী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি রুটে চলাচল করবে।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চিলাহাটি হয়ে ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি যাবে ট্রেনটি। ঢাকা থেকে চিলাহাটির দূরত্ব ৪৫৩ কিলোমিটার ও চিলাহাটি থেকে নিউ জলপাইগুড়ির দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার। আপাতত ভারতীয় রেক দ্বারা সপ্তাহে দুদিন চলাচল করবে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিউ জলপাইগুড়ি সোমবার ও বৃহস্পতিবার এবং নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রবিবার ও বুধবার চলাচল করবে। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটির ভাড়া হচ্ছে এসি কেবিন (বার্থ) ৪ হাজার ৯০৫ টাকা। এসি সিট ৩ হাজার ৮০৫ টাকা। এ ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত হবে ভ্যাট ও ট্রাভেল ট্যাক্স।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুদিনের সফর শেষে রাত সাড়ে ৯টায় আবার দিল্লী ফিরে যান।