নেতাকর্মীদের মাঠে নামানোর কৌশল নিয়ে গোপনে কাজ করছে জামায়াত

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশে সন্ত্রাস, নাশকতার নীলনক্সা তৈরি করে মরিয়া হয়ে মাঠে নামার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করছে জামায়াত-শিবির। সন্ত্রাসী ও নাশকতার মামলার আসামি গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আছে এমন হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে তৎপর করার জন্য কৌশল নিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী এই দলটি। সন্ত্রাসী ও জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপনের কৌশল হিসেবে নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগ, গণমাধ্যম কর্মী ও পেশাজীবী সংগঠনে অনুপ্রবেশ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই এই ধরনের কৌশল নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের। জামায়াত-শিবিরের অর্থের যোগান দিচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যুদ্ধাপরাধীদের গোষ্ঠী। গত সেপ্টেম্বর মাসে জামায়াতের মজলিশে শূরার অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল বৈঠক থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামার প্রস্তুতিমূলক যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারের প্রাণঘাতী করোনা সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতা মোকাবেলা ও পুলিশ বাহিনীর মানবতার কল্যাণে মনোযোগী হওয়ার সুযোগে সংগঠনকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করতে জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে এমন গোপন তথ্য পেয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বরে জামাতের মজলিশে শূরার এক ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াতের আমিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনাসহ নানা ধরনের ব্যর্থতা তুলে ধরার জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায় থেকে জনসংযোগ বৃদ্ধি করে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার পর থেকে সারাদেশের কোথাও না কোথাও ঝটিকা মিছিল, কর্মী সমাবেশ করছে সংগঠনটির তৃণমূল পর্যায়ে। গত কয়েক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী লাগাতার সাঁড়াশি অভিযানের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া নিষ্ক্রিয় জঙ্গি সংগঠনের নেটওয়ার্ক কানেকশন করার মাধ্যমে আগের মতো জঙ্গিদের চাঙ্গা করতে মরিয়া জামায়াত-শিবির। এই লক্ষ্যে জঙ্গি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জামাত নেতারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য গোপন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে জামায়াত-শিবির।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী করোনাভাইরাস মোকাবেল, কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যাকা-, দিনাজপুরে ইউএনওকে হত্যার চেষ্টা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি দুর্নীতিসহ নানা ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে বেশি মনোযোগী ও ব্যস্ততার মধ্যে দিনকাল কাটাচ্ছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাপের মধ্যে আছে। এই অবস্থায় এখন জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযান স্তিমিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এখন, জামায়াত-শিবির গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার মানুষজনের জানমাল রক্ষায় ব্যস্ত থাকার সুযোগ ও নানা স্পর্শকাতর ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশে সরকারবিরোধী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তারা একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে জামায়াত-শিবির।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা এখন আওয়ামী লীগের আশ্রয় প্রশ্রয়ে ছত্রছায়ায় চলে গেছে, যা সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের কাছে বার্তা পৌঁছে গেছে। কোন কোন জেলায় তারা পুলিশের সহায়তাও পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি দলীয় প্রচারপত্র বিলি করেছেন। দলের নেতাদের বাড়িতে চলছে নিয়মিত বৈঠক। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছেন হোয়াটসএ্যাপ, সিগন্যাল, মেসেঞ্জার এ্যাপ এবং দেশে বসে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশী মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে। সারাদেশে নেতাকর্মীরা মসজিদে ফজরের নামাজের আগে কিংবা এশার নামাজের পরে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের আপাতত নিজেদের রক্ষা করে চলার পরামর্শ অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনে যোগদান, আইনজীবীসহ পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে মিশে যাওয়া, গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে যোগদান করে জেলা উপজেলা, মহানগরে সংগঠনকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছে সংগঠনটি।
পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেয়ার কৌশল নিয়ে দলীয় কর্মকান্ড সচল রাখতে নেতাকর্মীদের নিয়মিত বৈঠক করার স্থান হিসেবে মসজিদ, তাদের নিয়ন্ত্রিত একটি হাসপাতাল ও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিতে বলা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী দলটির মগবাজারের কেন্দ্রীয় র্কার্যালয়ের পরিবর্তে আমির ডাঃ শফিকুর রহমানের মিরপুরের বাসভবনটিকেই এখন দলীয় কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করাসহ দলের আদেশ নির্দেশ আদান প্রদানের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে প্রকাশ্য মিছিল করে সংগঠনটি রাজনীতিতে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দেয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের দলে জামায়াতের অনুপ্রবেশের বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও থেমে নেই অনুপ্রবেশ। গত ৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ওই কমিটির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে। তিনি ছিলেন জামায়াতের সদর উপজেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক, নাশকতার ১৭টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গত কয়েক মাসে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্র থেকে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা সদরে একটি কমিউনিটি হাসপাতাল ভবনের চতুর্থ তলা উদ্বোধন উপলক্ষে হাসপাতাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠান হয়। মূলত উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আড়ালে এটি ছিল জামায়াতের সভা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা জামায়াতের আমির আবদুল বারী। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতার পাঁচ মামলা। তার স্ত্রী জাহানারা সদর উপজেলা মহিলা জামায়াতের সভানেত্রী। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে চারটি মামলা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির নুরুল হুদা। এভাবে নানা উপলক্ষ নিয়ে তারা ওই হাসপাতালে মাসে একবার সভা করেন। গত ২৮ আগস্ট পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা সদরে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে অনলাইনে নীতিনির্ধারণী একটি বৈঠকে অংশ নেন মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী এলাকার জামায়াত নেতারা। সভায় অংশ নেন সাঁথিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার, সাঁথিয়া পৌর জামায়াতের আমির শফিকুল ইসলামসহ অর্ধশত নেতা। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় প্রচার সপ্তাহ পালন করেন উপজেলা জামায়াতের নেতাকর্মীরা। পাংশার গ্রামে গ্রামে তারা জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটি প্রকাশিত দাওয়াতপত্র বিলি করেন। বিভিন্ন হাটেও প্রচারপত্র বিলি করা হয়। প্রচারপত্র বিলি করার নেতৃত্ব দেন রাজবাড়ী জেলা জামায়াতের রুকন পেশোয়ার আর্সলান মনরো, তার চাচাত ভাই কাজী ফরহাদ জামিল রূপুসহ দলের নেতাকর্মীরা।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৩ অক্টোবর সকালে খোদ রাজধানীর ছনটেক মেইন রোড এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা জামায়াতে ইসলামী। এতে সহস্রাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। বিক্ষোভে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ নেতৃত্ব দেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের নেতৃত্বে মিছিলটি যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু হয়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে এক সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের মধ্যে মিরপুরের বাইশটেকী, মিরপুরের কাজীপাড়া ও মনিপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় রয়েছে জামায়াতের শক্ত অবস্থান।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদন্ড হওয়ার পর অনেকটাই নিষ্ক্রিয় নিষ্প্রভ হয়ে যায় জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি। দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ব্যবহার করায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আরেক দফা হোঁচট খেয়ে গর্তের মধ্যে পড়ার উপক্রম হয়। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে নাশকতার মামলায় জড়িয়ে যান কয়েক হাজার নেতাকর্মী। এতে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় দলীয় কর্মকান্ড। এই ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতির প্রতিকূলতার কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে জামায়াত-শিবির নামের স্বাধীনতা বিরোধী দলটি। জামায়াত-শিবিরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী সন্ত্রাস, নাশকতার মামলার আসামি, গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ ও সময়ের জন্য ওঁৎ পেতে আছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।