গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তালিকা ॥ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগে অনুপ্রবেশকারী দেড় হাজার ॥ বহিষ্কার সহ নেওয়া হবে আইনানুগ ব্যবস্থা

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দুর্নীতিবিরোধী চলমান শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোতে অনুপ্রবেশকারী বা হাইব্রিড কিংবা কাউয়া নামে অভিহিতদের তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। এই তালিকায় আছে ১৫০০ জন। তারা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগে অনুপ্রবেশ করেছে। সরকারী দলের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তারা সুবিধাভোগী। বিগত ১০ বছরে দলটিতে অনুপ্রবেশ করেছে তারা। বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ফ্রিডম পার্টিসহ বিভিন্ন দল তো বটেই, এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের প্রজন্মও অনুপ্রবেশ করেছে। অনুপ্রবেশকারীদের এই তালিকাটির বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেয়ার জন্য পাঠানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে। যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, মোহাম্মদপুরের কাউন্সিলর পাগলা মিজান ফ্রিডম পার্টি থেকে এবং টেন্ডার কিং জিকে শামীম যুবদল থেকে যুবলীগে অনুপ্রবেশ করার তালিকাটি প্রকাশ পেয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যাকা-ের ঘটনায় যে ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে তার মধ্যে অন্তত ৩ জন বিএনপি-জামায়াত-শিবির থেকে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। অনুপ্রবেশকারীদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিমও তালিকা তৈরিতে সম্পৃক্ত। গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিমের তৈরি তালিকাটি সঠিক হয়েছে কিনা তা যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের পর থেকে যারা আওয়ামী লীগে বা অঙ্গ সংগঠনে ঢুকেছে, তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীদের চিহ্নিত করা হবে। দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী হিসেবে তারা চিহ্নিত হবে যারা অর্থ আত্মসাত করা বা দুর্নীতি করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। যারা দলের প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এবং মাদকের মামলায় জড়িত বা চার্জশীটভুক্ত তারাও চিহ্নিত হবে। চিহ্নিত করা হচ্ছে দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে সরকারী কাজে হস্তক্ষেপ, নিয়োগবাণিজ্য ও দলীয় কোন্দলে জড়িত এমন ব্যাক্তিদেরও। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, তারা দলের পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন অপকর্মে নিজেদের জড়াচ্ছে তাদের দল থেকে বহিষ্কারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এমন চিন্তাভাবনা আছে দলীয় হাই কমান্ডে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীর অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ওপর হামলাকারী ফ্রিডম পার্টির লোকজনও ঢুকে পড়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রথম গ্রেফতার হওয়া ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুব লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা গেল খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া একসময় ফ্রিডম পার্টি করত। তারপর যুবদল হয়ে যুবলীগে ঠাঁই নিয়েছে। পরে জানা গেল, খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া শুধু ফ্রিডম পার্টি নয়, শেখ হাসিনার ওপর হামলা মামলার আসামি ছিল। একইভাবে টেন্ডার সম্রাট জি কে শামীম এক সময় মির্জা আব্বাসের ডান হাত ছিলেন, করতেন যুবদল। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে দল বদলে যুবলীগ হয়ে গেছেন জিকে শামীম। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২নং ওয়ার্ডেও কাউন্সিলর ও মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে। পাগলা মিজানও একসময় ফ্রিডম পার্টি করত এবং শেখ হাসিনার ওপর হামলা মামলার আসামি ছিল। বুয়েটে আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগের ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতারাই আবিষ্কার করেছেন, এই ১৯ জনের মধ্যে অন্তত ৩ জনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জামায়াত বা বিএনপির।
গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি সাব-কমিটি(উপ কমিটি) গঠন করা হয়েছে যাতে এমন ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছেন যারা জেলা, থানা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে কোন সাংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নয়। অথচ দলটির কেন্দ্রীয় সাব-কমিটিতে কিভাবে স্থান পেয়েছে, কারা স্থান করে দিয়েছে প্রায়শ : দলের নেতা-কর্মীদের মুখে সেই প্রশ্ন। জামায়াত হোক, শিবির হোক, বিএনপি হোক, ফ্রিডম পার্টি হোক তারা তো নিজেদের অতীত ঢাকতে, সুবিধা পেতে আওয়ামী লীগের আড়াল চাইবেই। প্রশ্ন হলো, কারা তাদের আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার, বড় পদ বাগিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে তাদের বিষয়েও খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত, ফ্রিডম পার্টির নেতা-কর্মীরা খোলস বদলে আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকার বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অনেক আগেই বলেছিলেন ছাত্রলীগে শিবির ঢুকেছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ওবায়দুল কাদের কখনও তাদের ‘হাইব্রিড’, কখনও ‘কাউয়া’ বলেছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে কথা বলেছেন। দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনে সুবিধাভোগী অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই সুবিধা ভোগের জন্য অনুপ্রবেশকারী হয়ে টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।