সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে সরকার

45

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন, পুরনো আইন সংস্কার ও তা বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। বিশ্বের ৫৭ দেশের সঙ্গে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। জঙ্গি অর্থায়ন ও অর্থপাচার রোধে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমের ওপর। এছাড়া অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সরকার ৩ বছর (২০১৮-২০) মেয়াদী একটি জাতীয় কৌশলপত্র তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব কর্মকা-ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানদ- নির্ধারণকারী সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং (এপিজি)। এপিজির বার্ষিক সভা আগামী বছর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে তৈরি করা এ্যাকশন প্ল্যানটি ওই সভায় উপস্থাপন করার প্রস্তুতি নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, নানা ধরনের জটিলতার মুখে অর্থ পাচার, সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনটি পুরোপুরি দেশে কার্যকর হতে পারছে না। এতে জঙ্গি ও সন্ত্রাসাবাদে অর্থায়ন কমছে না, বরং বাড়ছে অর্থ পাচার। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনটি অধিকতর কার্যকর করতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরাও। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দুই পন্থায় অর্থ পাচার হচ্ছে। এক ব্যাংক ব্যবস্থা, অন্যটি আমদানি-রফতানির আড়ালে। এর বাইরে বড় আকারে অর্থ পাচার হওয়ার তেমন কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এখন তা বন্ধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বন্দরগুলোতে স্ক্যানার মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওভার প্রাইসিং আর আন্ডার প্রাইসিং প্রতিরোধে পিএসআইর আদলে এনবিআরে একটি সেল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশ থেকে টাকা পাচার অনেক কমে আসবে।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, কোন চালানে যদি বড় অনিয়ম পাওয়া যায়, সেটি বাজেয়াফত করা হবে। যারা এসব অপকর্ম করবে, তাদের এখন শুধু জরিমানা গুনতে হয়। সামনে জরিমানার পাশাপাশি তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হবে। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত আইনগুলো অনেক আগেই করা হয়েছে। তবে তখন মানিলন্ডারিং ও টেরোরিস্ট ফিনান্সিং বিষয়ে কিছু ছিল না। সুতরাং আইনগুলোর সংস্কার করা হবে। এছাড়া মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার মধ্য দিয়ে অর্থ পাচার রোধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। বিভিন্ন কৌশল ও আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে জঙ্গিরা অর্থ সংগ্রহ, পাচার ও খরচ করে থাকে। বাংলাদেশে এ সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকা পাচার ও সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়ন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালো টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না, বাড়ছে পাচার। আবার সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা বিভিন্ন কায়দা কৌশলে দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। জঙ্গিবাদ বিস্তারে খরচ হচ্ছে সেই টাকা। এতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এ বিষয়টির একটি ভাল সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে সারাদেশে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ৫৬১ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি। ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে জামায়াত-শিবির চক্র।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও বিএনপি-জামায়াত জোটের মৌলবাদী রাজনীতি বিশেষ করে হুজি, হরকাতুল জিহাদ, হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটছে। এছাড়া কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য থেকে পরিচালিত বিভিন্ন এনজিও, যাদের মধ্যে আছে চাষী কল্যাণ সমিতি, রাবেতা আল আলম আল ইসলাম, কাতার চ্যারিটেবল সোসাইটি, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল ফোরকান ফাউন্ডেশন, মুসলিম এইড বাংলাদেশ প্রভৃতি। এসব এনজিও থেকে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনও সহায়তা পেয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব সংগঠনের অর্থ নিয়ে অনেকে বিদেশ যাচ্ছে এবং সেখান থেকে অর্থ পাঠিয়ে জঙ্গিবাদ প্রসারে কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, জঙ্গিদের এনজিও এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের কিছু ব্যক্তির কাছে প্রচুর টাকা আছে। বিদেশ থেকেও নানা পথে তাদের টাকা আসে। এই অর্থায়ন বন্ধে জঙ্গি এনজিওগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে জামায়াত সারাদেশে যে এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছে, সেগুলো এখন তাদের ভোল পাল্টে ফেলেছে। তাই অর্থায়ন বন্ধে ব্যাংকগুলো যে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে।
এদিকে, সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড ও জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে সরকার ২০০২ সাল থেকে কাজ শুরু করে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। ব্যাংকিং চ্যানেলে জঙ্গি অর্থায়ন যাতে না হতে পারে তার জন্য কঠোর বিধিবিধান জারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (এফআইইউ)। এর মাধ্যমে ৫৭ দেশের সঙ্গে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে র‌্যাব, সিআইডি, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারী-বেসরকারী একাধিক সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে একাধিক আইনও।
জানা গেছে, টাকা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে ইতোপূর্বে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন পাস করা হয়। লক্ষ্য ছিল, দক্ষিণ এশীয় সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ করা। এছাড়া সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ও জাল নোট তৈরির মতো অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের সক্ষম করবে বলে মনে করা হয়েছিল। ওই আইনে মানিলন্ডারিং সম্পর্কিত অপরাধগুলোর সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২৮ কর্মকা-কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ অবৈধ অস্ত্রের বাণিজ্য, সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, পাইরেসি, উড়োজাহাজ ছিনতাই, অবৈধ মাদক বিক্রি, মানব পাচার, সংগঠিত অপরাধ, জিম্মি করা, কপিরাইট লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও ঘুষ, জাল করা, খুন ও শারীরিক ক্ষতি, যৌন অপব্যবহার, ভয় দেখানো, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, চোরাচালান ও পরিবেশগত অপরাধসমূহ। কেউ মানিলন্ডারিং বা লন্ডারিং সংশ্লিষ্ট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে চার থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার সম্মুখীন হবেন। তবে শাস্তি হিসেবে এই দ- এতদিন লঘু দ- হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাংলাদেশ নিয়ে দেশী ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের যে অপতৎপরতা রয়েছে তা বন্ধ হবে। পরবর্তীতে আইনটির চারটি ধারাও সংশোধন করা হয়। মানিলন্ডারিং আইনের ধারা ৯ অপরাধের তদন্ত ও বিচার, ধারা ১২ দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুমোদনের অপরিহার্যতা, ধারা ১৪ সম্পত্তির অবরুদ্ধকরণ বা ক্রোক আদেশ এবং ধারা ২৩ মানিলন্ডারিং অপরাধ দমন প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ক্ষমতা রয়েছে তা সংশোধন করা হয়েছে।