হতাশা বাড়ছে বিএনপি নেতাকর্মীদের

18

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিএনপি নেতাকর্মীদের হতাশা দূর করতে এমন কোন পন্থা নেই যা দলীয় হাইকমান্ড অবলম্বন করছে না। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। দলের নেতাদের মধ্যে কেউ বলছেন আন্দোলনের মাধ্যমে দলকে এগিয়ে নেয়া হবে আবার কেউ বলছেন সর্বস্তরে সংগঠনকে গুছিয়ে শক্তি সঞ্চয় করা হবে। কিন্তু চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে অবস্থান করায় সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় কোনভাবেই দলকে এগিয়ে নিতে পারছে না। বরং দলটি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এর ফলে সামনে দলের ভবিষ্যত অন্ধকার আঁচ করতে পেরে বিএনপি নেতাকর্মীদের হতাশা দিন দিনই বাড়ছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করে মাঠের রাজনীতি সক্রিয় করার চেষ্টা করে বিএনপি হাইকমান্ড। এ জন্য দলের কিছু সিনিয়র নেতাকেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তেমন উপস্থিতি না ঘটা এবং বেশ ক’টি এলাকায় উপস্থিত হওয়া নেতাকর্মীরা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে কর্মসূচী পন্ড করে দেয়ায় পর কেন্দ্র ঘোষিত গণসংযোগ কর্মসূচী থেমে যায়।
গণসংযোগ কর্মসূচী বিফল হওয়ার পর সর্বস্তরে সাংগঠনিক অবস্থা জোরদার করার চেষ্টা করে বিএনপি হাইকমান্ড। কিন্তু কিছু জেলা ও উপজেলা কমিটি এবং ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে দু’একটির কমিটি পুনর্গঠন করতে গিয়ে বড় রকমের হোঁচট খায় বিএনপি। এরপর সর্বস্তরে দল গুছানোর কাজও স্থবির হয়ে পড়ে। এর ফলে দল গুছিয়ে মাঠের রাজনীতি চাঙ্গা করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সব কিছু ব্যর্থ হওয়ার পর ঈদের আগ থেকে লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির সিনিয়র নেতারা আন্দোলন চাঙ্গা করার কথা জোরেশোরে বলতে থাকেন। কিন্তু তারেক রহমানের সাম্প্রতিক কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মনোক্ষুণ্ণ থাকায় দলের সিনিয়র নেতারা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এর ফলে তারা তারেকের সুরে সুর মিলিয়ে আন্দোলনের কথা বললেও বাস্তবে আন্দোলনের ধারেকাছেও থাকতে চাচ্ছে না। এ কারণে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরাও আন্দোলনে সায় দিচ্ছেন না।
এদিকে দেশে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দুর্বল। এ ছাড়া দুভাগে বিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে যারা আছেন তারাও দলীয় কর্মকান্ড এবং আন্দোলনের বিষয়ে তেমন আগ্রহী নন। বরং নিজ নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে তারা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ফলে রাজধানীর থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছে। তাই কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও হতাশা নেমে এসেছে।
বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দল গুছিয়ে সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে মাঠের রাজনীতিতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার যে চিন্তা করেছিল দলীয় হাইকমান্ড তা সফল হয়নি। সর্বস্তরে দলের কমিটি পুনর্গঠনের কাজও ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারেননি সিনিয়র নেতারা। দলের দুর্দিন কাটাতে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করতে পারেননি। তাই দলীয় কর্মকান্ড গতিহীন হয়ে পড়েছে। সাংগঠনিক কার্যক্রমে আবার কবে গতি আসবে তাও বলতে পারছেন না সাধারণ নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা বিভিন্নভাবে দলকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে নানান সমস্যার কারণে এ কাজে সফল হওয়া যায়নি। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা মনে করেছিলেন খালেদা জিয়া হয়তো গ্রেফতার হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেয়ে যাবেন। আর জামিনে মুক্তি পেলে তিনি সরাসরি সময়োপযোগী নির্দেশনা দিয়ে দলীয় কর্মকান্ড গতিশীল করতে পারবেন। কিন্তু তা যখন হলো না তখন নতুন করে দল নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়।
ইদানীং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা বেশি বেশি করে একটি কথা বলছেন। আর তা হচ্ছে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আবার দলকে সুসংগঠিত করা হবে। আর এভাবেই বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জাতীয় কাউন্সিলের দাবি উঠলেও এর পক্ষে সায় দিচ্ছেন না বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাই দলের পুনর্গঠনও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, বিএনপির উচিত ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সর্বস্তরে দল গুছিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলন চাঙ্গা করার চেষ্টা করা। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী দিতে না পারায় সর্বস্তরের বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। আর দলের সিনিয়র নেতারা হাঁকডাক দিয়েও রাজপথে কোন কর্মসূচী দিতে না পারায় বিএনপির রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ কমে যায়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে দল বিমুখ হয়ে পড়ে। কেউ দল ত্যাগ করে অন্য দলে চলে যায়। আবার কেউ কেউ রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। কেউ কেউ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।
উল্লেখ্য, বিএনপির রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে ওয়ান-ইলেভেনের সময়। দলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে সংস্কারপন্থী বিএনপি গঠন করার পর সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে এ দলের রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর আরেক দফা ধাক্কা খায় বিএনপি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশব্যাপী লাগাতার সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। এর ফলে এক পর্যায়ে আন্দোলনে ব্যর্থ হয় দলটি। এ পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। এরপর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালন করে তারা। এ আন্দোলনে ব্যাপক হারে পেট্রোল বোমা ও জ্বালাও-পোড়াও এর ঘটনা ঘটায় প্রায় ২শ’ মানুষ নিহত, হাজার তিনেক যানবাহনসহ অসংখ্য স্থাপনার ক্ষতি হয়। দেশের মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি সেই সহিংস আন্দোলনের কথা। এ আন্দোলনের পর বিদেশীরাও বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিদেশীদের সহযোগিতা চেয়েও পায়নি বিএনপি। তবে বিদেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে বার বার কূটনীতিকদের ডেকে বৈঠক করলেও তাতে কাজ হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনৈতিকভাবে বিএনপি এখন চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। নানামুখী সমস্যার কারণে দলীয় কর্মকান্ড ও আন্দোলন গতিশীল করা যাচ্ছে না। তবে রাজনীতিতে উত্থানপতন স্বাভাবিক ঘটনা।