আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ॥ ৭ মার্চের ভাষণ যারা নিষিদ্ধ করেছিল ওরা আস্তাকুঁড়ে যাবে

87
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামীলীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ উল্লেখ করে বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বাংলাদেশী মুক্তিকামী মানুষ না, সারাবিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের প্রেরণা হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে রইবে। আর যারা ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিল তারা ধীরে ধীরে আস্তার্কুড়ের দিকেই চলে যাবে, নিঃশেষ হয়ে যাবে। বেঁচে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের মানুষকে যারা ভালবাসবে। যুগ যুগ ধরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু দেশের মানুষকেই নয়, বিশ্বের সকল নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে প্রেরণ দিয়ে যাচ্ছে, আগামীতেও যাবে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্স উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা। ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’। বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। যুগের পর যুগ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পুরো জাতিকে এখনও নতুন করে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেশপ্রেম, ত্যাগ ও আদর্শের মহিমায় উজ্জীবিত করে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ ভাষণ আছে, কিন্তু ৪৮ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মতো আর কোন ভাষণ এতবার বাজেনি। তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ, এটি এখন প্রমাণিত সত্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিশিষ্ট গবেষক কর্নেল (অব) সাজ্জাদ জহির, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, কেন্দ্রীয় নেতা ডাঃ শামসুন্নাহার চাঁপা, আনোয়ার হোসেন ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাত ও উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান। কবিতা আবৃত্তি করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। আলোচনা সভা পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তাঁরই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর এই ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। যেহেতু পাকিস্তানী হানাদারদের এই ভাষণটি পছন্দ নয়, সেজন্য ক্ষমতা দখল করে এই ভাষণটি বাজানো নিষিদ্ধ করেছিল ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানরা। পরবর্তী সামরিক স্বৈরাচাররাও একই পথ অনুসরণ করে, রণাঙ্গণের সেøøাগান জয় বাংলাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সত্যকে কখনও অস্বীকার করে মুছে ফেলা যায় না।
তিনি বলেন, জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ একেকটি কোটেশন হয়। ভাষণের প্রতিটি লাইন, শব্দ বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের অনুপ্রেরণা জোগাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আজীবন টিকে থাকবে। ৪৮ বছর হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের আবেদন এখনও এতটুকুও কমে যায়নি।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং ৪৮ থেকে ৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের পান্ডুলিপিগুলো আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে পড়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বইগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কত ত্যাগ করেছেন, কত কষ্ট করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর এই একটি মাত্র ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে পারছি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আমরা পেয়েছি একটি ভাষাভিত্তিক স্বাধীন দেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর অনেক বড় বড় নেতা অনেক শ্রেষ্ঠ ভাষণ দিয়েছেন। গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলো নিয়ে গবেষণা হয়েছে। গবেষণার পর যে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলো স্থান পেয়েছে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি। সে কারণে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
তিনি বলেন, গত ৪৮ বছর ধরে কতবার, কত সময়, কত ঘণ্টা বা কত মিনিট এই ভাষণটি বাজানো হয়েছে, কত মানুষ শুনেছেন তার কোন হিসাব নেই। পৃথিবীর অন্য কোন নেতার ভাষণ এতবার বাজানোর কোন ইতিহাস নেই। সারাবিশ্বে ৭ মার্চের ভাষণটি এখনও সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে, ভাষণটি আবেদন এখনও এতটুকু কমেনি। বিশ্বের বড় বড় নেতার ভাষণগুলো একবার বেজেই থেমে গেছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি যুগ যুগ ধরে বেজেই যাচ্ছে, দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক শ্রেষ্ঠ ভাষণ আছে সেগুলো ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণ অলিখিত, কোন নোট পর্যন্ত ছিল না। বঙ্গবন্ধু যা বিশ্বাস করতেন, সেই মনের কথাটিই বলে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা দীর্ঘ ২১টি বছর এই ভাষণটি বাজানো নিষিদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ছবি নিষিদ্ধ করেছিল। যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য হানাদারবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অকাতরে জীবন দিয়ে গেছেন, সেই শ্লোগানটিও নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ভাষণটি বাজাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদানের আগ মুহূর্তে পিতার পাশে থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষণটি দেয়ার আগে অনেক বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক নেতা এমনকি ছাত্রলীগের নেতারাও বঙ্গবন্ধুর কাছে অনেক নোট দিয়ে বলেছিলেন, এসব বলতে হবে। কাগজের যেন বস্তা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে যাবেন, ঠিক তখন আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাবাকে ওপরে নিয়ে গিয়ে পাশে বসেন। তখন আমিও বাবার মাথার কাছে বসে মাথা বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। তখন মা বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলবে। ময়দানে লাল লাখ মানুষ তোমার মুখের দিকে চেয়ে বসে আছে। তুমি দেশের মানুষের জন্য অজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছ। তাই তাদের জন্য কী করতে হবে তোমার চেয়ে কেউ তা বেশি বুঝবে না। তাই তোমার মনে যা আসবে সেটিই বলবে।’ বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন। কোন নোট বা লিখিত কাগজ ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর মনে যা ছিল সেটিই ভাষণে বলেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কী করেছেন, তা ওই সময় পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্টেই স্পষ্ট উল্লেখ আছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ে গোয়েন্দা সংস্থার ওই রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করে আমরা বই আকারে বের করছি। ইতোমধ্যে দুই খন্ডের বই বেরিয়েছে, তৃতীয় খন্ডের কাজ চলছে। সমস্ত রিপোর্টগুলো নিয়ে ১৪ খন্ডের বই বের করা হবে। এই রিপোর্টগুলো পড়লেই সবাই জানতে পারবেন একটি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন দেশের জন্মের ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনও বিশ্বের ইতিহাসে বিরল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে অসহযোগী আন্দোলন হয়েছে, পরে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন থেকেই একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর মতো অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বের আর কোন নেতাই করতে পারেননি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আলোচনার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন থাকায় গণভবনের বাঙালি বাবুর্চিরা রান্না করতে পর্যন্ত অস্বীকার করে। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে তখন বলা হয়েছিল, একটু অনুমতি দেন, নইলে রাষ্ট্রপতি একটু গরম ভাতও খেতে পারবেন না। এমন অসহযোগী ঘটনা বিশ্বে শুধু বিরলই নয়, একটি অনন্য ইতিহাসও রচনা করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু।