১০ মার্চ ছাতক উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ॥ ভোটের লড়াইয়ে কে হাসবেন বিজয়ের হাসি ?

183

আতিকুর রহমান মাহমুদ ছাতক থেকে :
ছাতকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচার-প্রচারণা। নবীন ও প্রবীণ প্রার্থীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত কে হাসবেন বিজয়ের হাসি এ নিয়ে কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। স্ব স্ব প্রার্থীরা সভা-সামাবেশ, উঠান বৈঠক ও গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। নিজের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। ভোটারদের মতে নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু ও সহনশীল থাকলে এবং ভোটাররা নির্বিঘেœ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে এ উপজেলায় এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হতে পারে। তবে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি-জামায়াতের কোনো প্রার্থী অংশ না নেয়ায় নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনী আমেজ নেই। তারা নির্বাচনে ভোট দিতে যাবে না এমন মন্তব্য অনেক নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ছাতক উপজেলায় বেসরকারি হিসেব অনুযায়ি ৮শ’২১টি গ্রাম ও পাড়া-মহল্লা রয়েছে। এসব গ্রাম, পাড়া-মহল্লা নিয়ে ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা গঠিত। দেশের অন্যতম উপজেলা হচ্ছে এটি। বিভিন্ন শিল্পকারখানা এখানে স্থাপন হওয়ায় এ উপজেলাকে শিল্পনগরী হিসেবে দেশ-বিদেশে বেশ পরিচিতি রয়েছে। এখানে ১শ’টি ভোট কেন্দ্রে ও ৬শতাধিক বুথে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৭শ’৩৫জন ভোটার। তন্মধ্যে পুরুষ ভোটার ১লক্ষ ৩১হাজার ৮শ’৮১জন এবং নারী ভোটার ১লক্ষ ২৯হাজার ৮শ’৫৪জন। এ উপজেলায় এবারের নির্বাচনে ৩টি পদের বিপরীতে সর্বমোট ১৩জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৮জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩জন প্রার্থী। চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান অলিউর রহমান চৌধুরি বকুল কাপ-পিরিচ প্রতীক ও আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী ফজলুর রহমান নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আবু সাদাত লাহিন টিউবওয়েল, শাহীন চৌধুরি টিয়া পাখি, ইজাজুল হক রনি তালা, আতাউল হক সানি বই, বাবুল রায় মাইক, আবদুল গফফার উড়োজাহাজ, এডভোকেট মাসুম আহমদ চশমা ও শামীম আহমদ লাঙ্গল। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে শিখা রানী দে পদ্মফুল, লিপি বেগম কলস ও নাছিমা আক্তার চামেলী ফুটবল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চেয়ারম্যান পদে প্রবীণের সাথে লড়াই হবে নবীনের। উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে এমপি মুহিবুর রহমান মানিকসহ উপজেলার বেশ ক’জন ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছেন দলীয় প্রার্থী ফজলুর রহমানের সাথে। ছাতক উপজেলা আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে এমপি মুহিবুর রহমান মানিক এবং পৌর মেয়র আবুল কালাম চৌধুরি ও তার অনুজ সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক শামীম আহমদ চৌধুরির নেতৃত্বে দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে আছে। বিগত উপজেলা নির্বাচনে এমপি বলয় থেকে কাপ-পিরিচ প্রতীকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের ভগ্নিপতি অলিউর রহমান চৌধুরি বকুল। ওই নির্বাচনে পৌর মেয়র আবুল কালাম চৌধুরি-শামীম চৌধুরি বলয় থেকে প্রার্থী করা হয়েছিল প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা আবরু মিয়া তালুকদারকে। দলীয় মনোনয়ন না থাকায় ওইসময় উভয়ই দলীয় সমর্থীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এছাড়া বর্তমান নৌকার প্রার্থী ফজলুর রহমানসহ ৭জন প্রার্থী বিগত উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচনের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে ফজলুর রহমান জামানত হারিয়েছিলেন। সেই সময় বকুল চৌধুরিকে দলের একক প্রার্থী ঘোষনা করায় এমপি বলয়ের অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশী মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে অভিমান করে স্বতন্ত্র প্রার্থী, বলয় ছেড়ে অনেকেই প্রকাশ্যে ও গোপনে কাজ করেছিলেন। চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আ’লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় সদ্য সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অলিউর রহমান চৌধুরি বকুলের নাম দেয়া হয়নি। অবশেষে তিনি দলের তৃণমুল পর্যায়ে নেতা-কর্মী, সমর্থকদের নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মাঠে লড়ছেন। তার পক্ষেও রয়েছে তৃণমুল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ। চেয়ারম্যান পদে আর কোন প্রার্থী না থাকায় আওয়ামীলীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে জমজমাট লড়াইয়ের প্রত্যাশা করছেন ভোটাররা। তবে দলীয় নেতা-কর্মীরা দ্বিধা-বিভক্ত থাকায় একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে নৌকার প্রার্থী ফজলুর রহমানকে।
এদিকে একাধিকবার জনপ্রতিনিধিত্ব করার সুবাদে নির্বাচনী অভিজ্ঞতায় অনেকটাই এগিয়ে আছেন বিদ্রোহী প্রার্থী বকুল চৌধুরি। তিনি আবারো কাপ-পিরিচ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেয়ায় এটিকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখছেন সাধারণ ভোটাররা। পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে পেছনে ফেলে ভোটের পাল্লা অনেকাটাই ভারি করে ফেলেছেন তিনি। একটি রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধির পরিবারের সন্তান অলিউর রহমান চৌধুরি বকুলের পিতামহ তফজ্জুল আলী চৌধুরি ছিলেন গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের একজন চেয়ারম্যান। তার পথ ধরেই বকুল চৌধুরির পিতা মরহুম আজিজুর রহমান চৌধুুরিও একই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। পিতার হাত ধরে তরুণ বয়সে ১৯৯২ ও ১৯৯৮ সালে পর পর দু’বার ইউপি চেয়ারম্যানের আসনে বসে ইউনিয়নবাসীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বকুল চৌধুরি। জাতীয় স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের আসনে বসেও তিনি প্রতিনিধিত্ব করার গৌরব অর্জন করেছেন। সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। সরকারি সফরে একাধিকবার দেশের বাহিরেও গিয়েছেন তিনি। এসব কারণে উপজেলার প্রতিটি এলাকায়ই বকুল চৌধুরির ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। গেল ৫ বছরে শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পন্ন হয়েছে। বিজয়ের ক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই এগিয়ে আছেন বলে সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন।
অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা ফজলুর রহমান রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন পরিচিত মুখ। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি একজন লেখক-গবেষকও। পরিচ্ছন্ন রানীতিবিদ হিসেবে এলাকায় তার বেশ পরিচিতি ও সুনাম রয়েছে। দীর্ঘ রাজনীতির স্বীকৃতি স্বরূপ দল তাকে মূল্যায়ন করে এ নির্বাচনে তার হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দেয়া হয়েছে। তার বক্তব্য অনুযায়ি নৌকা প্রতিকটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। নিজের পরিচয় ও দলীয় ইমেজ কাজে লাগিয়ে তিনিও ১০মার্চে নির্বাচনী বৈতরণী পারি দিতে চান। তার কর্মী-সমর্থকরাও মনে করেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে ফজলুর রহমান ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। অপর দিকে এ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের জোটের কোন প্রার্থী না থাকায় এখানে তাদের বিশাল ভোটের হিসেব কষছেন প্রার্থীরা। তাই দলমত নির্বিশেষে প্রার্থীরা বিএনপি জামায়াতসহ জোটের সমর্থক ও ভোটারদেরকে মূল্যায়নের চোখে দেখছেন। এ উপজেলায় শেষ পর্যন্ত কে হাসবেন বিজয়ের হাসি? কে পড়বেন বিজয়ের মালা ? এই অপেক্ষায় উš§ুখ হয়ে আছেন ভোটাররা। রোববার অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রদান করতে পারবেন এমনটাই প্রত্যাশা করছেন এখানকার ভোটাররা।