গোলাপগঞ্জে সরকারি নির্দেশনা মানছে না কোচিং সেন্টারগুলো

43

সেলিম হাসান কাওছার গোলাপগঞ্জ থেকে :
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বেপরোয় হয়ে উঠছে গোলাপগঞ্জ উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। কোচিং বাণিজ্যর শীর্ষ তালিকায় রয়েছে গোলাপগঞ্জ সরকারি এমসি একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষকরা। বিগত সময়ে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন কারণে আলোচনায় ও সমালোচনায় আসে। উপজেলার সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি। ৩ হাজার ৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন ওই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রাইমারী থেকে কলেজ শাখা পর্যন্ত শিক্ষক রয়েছেন ৬৬ জন। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী অধ্যাপকসহ ৫০ জনই শিক্ষক কোচিং পাঠশালা নিয়ে ব্যস্ত। শুধু এমসি নয় উপজেলার ৪০টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৮৫% শিক্ষকদের কোচিং পাঠশালা রয়েছে। তারা বাসা বাড়ীসহ বিভিন্ন দোকানঘর ভাড়া করে দীর্ঘদিন থেকে কোচিংয়ের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। উপজেলা মাধ্যমিক অফিসের তথ্য অনুযায়ী এ উপজেলায় ৩৬টি স্কুল এন্ড কলেজ ও ৪টি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। চলমান এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে ১ মাসের জন্য সব ধরণের কোচিং বন্ধের রুল জারী করেন হাইকোর্ট। তাছাড়া সব ধরণের প্রাইভেট পড়ানো অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট এবং সরকারী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকাল ৭টায় কোচিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের তথ্য অনুযায়ী এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে স্কুল কলেজের পাঠদানের চেয়ে কোচিং পাঠশালাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে না গেলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। তা অনেক আগ থেকেই এসব কার্যক্রম চলছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। গোলাপগঞ্জ রণকেলী গ্রামের সিরাজ উদ্দিন বলেন, আমার দুই মেয়েকে সকালে তাদের স্কুলের স্যারের কাছে কোচিংয়ে যেতে হয়। কোচিংয়ে যেসব পড়া দেওয়া হয় সেগুলো শিখে যেতে হয়। প্রথমে তারা তাদের স্যারের কাছে কোচিংয়ে যেতে না চাইলে তিনি বলেন ফেল করলে আমার করার কিছু নেই। এক মেয়ে ১০ম শ্রেণী ও অন্য মেয়ে কলেজে পড়ে। তারা দুইজন গোলাপগঞ্জ সরকারি এমসি একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজে পড়েন। অনেক অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে চাননি। কোচিং পাঠশালা রয়েছে উপজেলার পৌরসভা, ঢাকাদক্ষিণ, ভাদেশ^র, লক্ষণাবন্দ, শরীফগঞ্জ, হেতিমগঞ্জ, নারাপিং, আমুড়া, বাঘাসহ স্কুল কলেজ ও ডিগ্রি কলেজের আশপাশ এলাকার বাসা-বাড়ী ও দোকান ঘরে।
সরেজমিন (২০-২১ ও ২৩ ফেব্রুয়ারী) সকালে গোলাপগঞ্জ পৌরসভার ঘুরে দেখা যায়, এমসি একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজের দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেণীর (ইংরেজী) শিক্ষক নজরুল ইসলাম সুরমা ডাইক রোডের হক ভিলায় একই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছেন। এমসির রতন স্যার ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে একটি ভবনে নবম ও দশম শ্রেণীর ২৫/২৬জন শিক্ষার্থীকে গণিত পড়াচ্ছেন। সকাল সাড়ে ৮টায় এমসির সাজিদ স্যারকে পৌরসভার সামনে রোহেনা ভিলার নিচ তলায় দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেনীর ১০/১২জন শিক্ষার্থীকে (ইংরেজী) পড়াতে দেখা যায়। এমসির সাকিব আহমদ কদমতলীর মসজিদ মার্কেটের পেছনের একটি টিনসেটের ঘরে পর্দা লাগিয়ে দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেনীর ৪০/৪৫জন শিক্ষার্থীকে (ইংরেজী) পড়াতে দেখা যায়। এমসির আদিল আহমদ স্যারকে পল্লী বিদ্যুতের কন্টল স্টেশনের পেছনে নিজ বাড়ীতে দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেণীর প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে দেখা যায়। এ সময় ফটো তুলতে গেলে তিনি বলেন, আমি সুন্দর কাপড় পরে আসছি। ভাল করে ছবি তোলবেন সমস্যা নাই। এমসি কলেজের দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেণীর শিক্ষক ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম স্যারকে একটি টিনসেটের ঘরে ৫/৬জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে দেখা যায়। এমসির জাহান স্যারকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ শ্রেণীর পর্যন্ত প্রায় ৪০জন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াতে দেখা যায়। এছাড়া এমসির দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেনীর শিক্ষক আলাল আহমদ, সমুন আহমদ, সাকিব আহমদ, সুলতানা বেগম, আলম আহমদ, হাইস্কুলের জহর কান্তি পাল, রাজবি কুরমী, সহাকারী শিক্ষক আলীম আহমদ, সানমুন ইলেকট্রিকের পেছনে অজিৎ, জাহান আহমদ, আব্দুল হক, আফতাফ উদ্দিন, বদরুল ইসলাম, কলেজের ইংরেজী শিক্ষক সমুন আহমদ। ঢাকাদক্ষিণ সড়কের সোমা এক্সের পেছনে নাবিলা ভিলার পাশে রণকেলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক মুকুল স্যারকে দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেনীর প্রায় ৩০জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে দেখা যায়। উনার সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন,আমি জেনেই তাদের পাড়াচ্ছি। তিনি বলেন প্রাইভেট পড়াতে আইনের প্রয়োজন হয় না। আমি একজন মানবাধিকারের লোক। প্রাইভেট না পাড়াতে আমরা কোন চিঠি পাইনি। রহমানিয়া মাদ্রার পেছনে রমনা মহলের নিচ তলায় রুহুল আহমদ নামে এক শিক্ষককে ৭/৮জন কলেজের শিক্ষার্থীকে পড়াতে দেখা যায়। তিনি বলেন ওটা আমার নিজের বাসা। আমি অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি সমস্যা কোথায়। তিনি কুড়ার বাজার একটি কলেজে কর্মরত আছেন। ঘটনাস্থল থেকে ফিরে আসার পর তিনি ফোন দিয়ে বলেন,আমার নামটি আপনারা লেখবেন না আমি আপনাদের খুশি করবো। গোলাপগঞ্জ কৈলাশটিলা এলপি প্লান্টের সহকারী কর্মকর্তা শেখ মোস্তাফিজকে সরস্বতি সড়কের মোকাম মসজিদের সামনে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত ৪০/৪২জন শিক্ষার্থীদের পড়াতে দেখা যায়। উনার সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন,আমার কোন সমস্যা নাই পড়াতে। তাই পড়াচ্ছি।
গোলাপগঞ্জ সরকারি এমসি একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল মনসুর আহমদ চৌধুরীর সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, শিক্ষকদের এই বেতনে পরিবার চলেনা এজন্য তারা কোচিং করাচ্ছেন। তবে হাইকোর্টের আদেশটা এক মাসের জন্য মানার দরকার ছিল।
এ বিষয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অভিজৎ কুমার পালের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমি খোঁজ নিয়ে খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এ ব্যাপারে গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুনুর রহমানের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি দেখতেছি।