বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে আজ আখেরি মোনাজাত ॥ হেলিকপ্টারে এসে যোগ দিলেন আল্লামা শফী

46

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে টঙ্গীতে টানা চারদিনব্যাপী তবলীগ জামাতের ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছে। শীত আর নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে তবলীগ জামাতের এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে লাখ লাখ মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। মাওলানা জোবায়ের ও মাওলানা সাদ অনুসারীদের দু’দিন করে পৃথক ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এবারের বিশ্ব ইজতেমায় দু’টি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
শুক্রবার হতে শুরু হওয়া প্রথম ধাপের ইজতেমা শনিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। প্রথম ধাপের নেতৃত্বে থাকছেন জোবায়েরপন্থী আলেম ওলামা কওমিপন্থী তবলীগ অনুসারী মুসল্লিগণ। দ্বিতীয় ধাপের নেতৃত্বে থাকছেন সা’দ অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তবলীগ অনুসারীরা। এদিকে হেফাজতে ইসলাম প্রধান হযরত মাওলানা আল্লামা শফি ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়ে জুম্মার নামাজে শরিক হন। তিনি শনিবার আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত ইজতেমা মাঠে অবস্থান করবেন।
এবারের বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি নানা বিড়ম্বনাকে উপেক্ষা করে শুক্রবারেও টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে ছুটে আসেন। এদিন জুম্মা বার হওয়ায় সকাল থেকেই টঙ্গী ও আশপাশ এলাকার লাখো মুসল্লির ঢল নামে টঙ্গীর তুরাগ তীরে। নামাজের আগেই ইজতেমার পুরো প্যান্ডেল ও ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। প্যান্ডেলের নিচে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা অংশ নেন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ আশপাশের সড়ক ও গলিগুলোর ওপরে। আখেরি মোনাজাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুসল্লিদের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। শুক্রবার প্রথম দিনে বাদ ফজর থেকে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার বাদ আছর থেকে জোবায়ের অনুসারীদের বিশ্ব ইজতেমার বয়ান শুরু হয়েছে। আজ (শনিবার) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের দু’দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে যথারীতি তবলীগের ৬ উসুল অর্থাৎ কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, সহীহ নিয়ত ও তবলীগ ইত্যাদি বিষয়ে আমবয়ানের মাধ্যমে এজতেমার প্রথম পর্বের ২ দিনের কার্যক্রম শুরু হয়।
হেলিকপ্টারে করে আহমদ শফীর ইজতেমায় যোগদান : গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানান, হেফাজতে ইসলামের আমির ও হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী শুক্রবার জুম্মার নামাজে অংশ নেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইছাখালী থেকে বেসরকারী হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় টঙ্গীর বাটা সু কারখানা এলাকার হেলিপ্যাডে নামেন। পরে সেখান থেকে তিনি নিজ গাড়িতে করে ইজতেমার ময়দানে নির্দিষ্ট কামড়ায় পৌঁছে দেন তাকে। শনিবার আখেরি মোনাজাতেও অংশ নেবেন এবং আবার হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে চলে যাবেন।
জুম্মার নামাজে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ : শুক্রবার জুম্মার নামাজের ইমামতি করেন বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হযরত মাওলানা জোবায়ের। এদিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এড. আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, ধর্মবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ও গাজীপুর মেট্রো পুলিশ কমিশনার ওয়াইএম বেলালুর রহমান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আজম উল্লাহ খানসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ইজতেমা ময়দানে জুম্মার নামাজে শরিক হন। এদিকে দুপুরের আগে অনেকটা হঠাৎ করে হেফাজত ইসলাম প্রধান হযরত মাওলানা আল্লামা শফি হুজুর ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়ে জুমার নামাজে শরিক হন।
ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা : বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরব্বি প্রকৌশলী মোঃ মাহফুজুর রহমান জানান, শুক্রবার বাদ ফজর উর্দুতে চূড়ান্ত আমবয়ানের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক মূল বয়ান শুরু করেন। আর বাংলাদেশের নোয়াখালীর মাওলানা নূরুর রহমান তা বাংলায় তরজমা করেন। ইজতেমাস্থলের বয়ান মঞ্চ থেকে মূল বয়ান উর্দুতে হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ২৪টি ভাষায় তা তরজমা হচ্ছে। পরে তবলীগ মারকাজের শূরা সদস্য ও বুজুর্গরা ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত স¤পর্কে ফজিলতপূর্ণ সারগর্ভ বয়ান করেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজী, আরবী, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হয়।
আয়োজকরা বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার কর্মসূচীর মধ্যে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উসুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানোসহ নতুন জামাত তৈরি হবে। তবে এ বছর যৌতুকবিহীন বিয়ে হবে না।
আজ (শনিবার) মাওলানা জোবায়ের অনুসারিগণের আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। মোনাজাত শেষে জোবায়ের অনুসারিগণ ময়দান ছেড়ে চলে গেলে রবিবার থেকে মাওলানা সা’দ অনুসারিদের পরিচালনায় ইজতেমা ফের শুরু হবে। সোমবার মাওলানা সাদপন্থীদের আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এ পর্বের চার দিনের বিশ্ব ইজতেমা।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা : গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান জানান, জুম্মার নামাজ আদায় করতে আশপাশের জেলার অনেক মুসল্লি এখানে আসেন। জুম্মার নামাজ উপলক্ষে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যানজটমুক্তভাবে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ রাখা হয়েছে। জুম্মার নামাজে অংশ নেয়া মানুষ যাতে নির্বিঘেœ আসা যাওয়া করতে পারে।
সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আতঙ্কে আহত ২০ : টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে বয়ান মঞ্চের দক্ষিণে রান্না করার সময় শুক্রবার সকালে একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের গুজবে আতঙ্কিত হয়ে মুসল্লিরা ছুটোছুটি শুরু করে। এ সময় আশপাশে রান্না চলাকালে চুলার গরম হাঁড়ি-পাতিল পড়ে গিয়ে চুলার আগুনে পুড়ে ও দা-বঁটিতে কাটা পড়ে কমপক্ষে ২০ মুসল্লি আহত হয়েছেন। শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
ইজতেমায় আরও দুই মুসল্লির মৃত্যু : টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আরও দুই মুসল্লি মারা গেছেন। তারা হলেন- ফেনীর সফিকুর রহমান (৫৮) এবং কুষ্টিয়ার মোঃ সিরাজুল ইসলাম (৬৫)।
বিদেশী মুসল্লি : পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, ইজতেমার ১ম পর্বের প্রথম দিন আমেরিকা, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, লেবানন, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৮০টি দেশের প্রায় এক হাজারেরও বেশি মুসল্লি অংশ নিয়েছেন।
কন্ট্রোল রুম : বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা ও মুসল্লিদের খেদমতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের (ডেসকো) পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
ইজতেমায় বিদেশী মুসল্লি হ্রাস : ইজতেমা ময়দানে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে দায়িত্বপালনরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এবার দেশী মুসল্লিদের সংখ্যা বাড়লেও বিদেশী মুসল্লির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তবে পাসপোর্টের হিসাবমতে ২৪টি দেশ থেকে ৩০১ জন বিদেশী মুসল্লি ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা। কিন্তু বিগত ইজতেমাগুলোতে শুরুর দিনে বিদেশী মুসল্লিদের সংখ্যা ৭/৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তবে গাজীপুর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, এ সংখ্যা এক হাজারের মতো হতে পারে।