হারাম সম্পদের পরিণতি ও তার প্রতিকার

297

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
এ সম্পর্কে ২০০০ সালে জাতীয় গেজেটের ৮ নং আইনের ৭ ধারায় নারী ও শিশু অপহরণের শাস্তি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি ধারা-৫ এ উল্লিখিত কোন অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে কোন নারী বা শিশুকে অপহরণ করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অন্যূন চৌদ্দ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবে। যদি কোন ব্যক্তি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কোন নারী বা শিশুকে আটক করেন, তা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন।
ওজনে কম দিয়ে সম্পদ উপার্জন করা ইসলামে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং যারা এমন জঘন্যতম কাজে লিপ্ত থাকবে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ আল-কুরআনে ঘোষণা করেন: ‘‘যারা ওজনে ও মাপে কম দেয়, তাদের জন্য সর্বনাশ। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে আনার সময় ঠিকমত আনে, আর মেপে দেয়ার সময় কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে মহাদিবসে? যে দিন দাঁড়াবে সমস্ত মানুষ জগত সমূহের প্রতিপালকের সম্মুখে। কখনও না, পাপাচারীদের আমলনামা তো সিজ্জীনে আছে। সিজ্জীন সম্পর্কে তুমি কী জান? তা চিহ্নিত আমলনামা। সেই দিন দুর্ভোগ হবে অস্বীকারকারীদের, যারা কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে, কেবল প্রত্যেক পাপিষ্ঠ সীমালংঘনকারী এটি অস্বীকার করে।’’
ইমাম সুদ্দী বলেন: রসূল (স.) যখন হিজরত করে মদীনায় আগমন করেন তখন সেখানে অনেক লোক দেখতে পেলেন যারা নিজের জিনিস মেপে নেয়ার সময় বেশি নিত এবং অপরকে দেয়ার সময় ওজনে কম দিত; তখন আল্লাহ্ এ আয়াত নাযিল করেন। রসূল (স.) বলেছেন: ‘‘পাঁচটি জিনিসের ফলে পাঁচটি জিনিস অনিবার্য। যে পাঁচটি বিষয় হলো: কোন জাতি প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করলে আল্লাহ তার ওপর তার শত্র“কে চাপিয়ে দেবেন। কোন জাতি আল্লাহর বিধান ছাড়া মনগড়া বিধান দ্বারা দেশ শাসন করলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়বে, কোন জাতিকে অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে তাদের মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, মাপে ও ওজনে কম দিলে ফসল কম হবে ও দুর্ভিক্ষ হবে, আর যাকাত দেয়া বন্ধ করলে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে।’’ এখানে স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় যে, মাপে কম দেয়া ব্যক্তি প্রকৃত পক্ষে তিল তিল করে অলক্ষে চুরি করে এবং হারাম উপার্জন করে।
জবর দখল করা ইসলামী আইন নিষিদ্ধ। এ নিষিদ্ধ কাজটি সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জোরপূর্বক মানুষের সম্পদ হরণ, জোর পূর্বক অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া, মানুষকে প্রহার করা, গালিগালাজ করা, বিনা উস্কানিতে কারো ওপর আক্রমণ চালানো এবং আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন এবং দুর্বলদের ওপর নৃশংসতা চালানো ইত্যাদিকে জবর দখল বলে। এটি ইসলামে একেবারেই নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘‘জালিমদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না। আল্লাহ তাদেরকে শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন, যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফোরিত হবে, তারা মাথা নিচু করে দৌঁড়াতে থাকবে, তাদের চোখ তাদের নিজেদের দিকে ফিরবেনা এবং তাদের হৃদয়সমূহ দিশেহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আযাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও। সেদিন জুলুমবাজরা বলবে : হে আমাদের প্রভূ! অল্প কিছুদিন আমাদেরকে সময় দিন তাহলে আমরা আপনার দাওয়াত কবুল করবো এবং রসূলদের অনুসরণ করবো। তোমরা কি ইত:পূর্বে কসম খেয়ে বলতে না যে তোমাদের পতন নেই। যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বাস করেছ এবং সেই সব জালেমের সাথে আমি কেমন আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্ত আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি।’’
রসূল (স.) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণও অন্যের জমি জবর দখল করবে, কিয়ামতের দিন তার ঘাড়ে সাতটি পৃথিবী চাপিয়ে দেয়া হবে।’’
প্রচলিত আইনে, অন্যায়ভাবে অন্যের ভূমিতে প্রবেশ করা অথবা ভূমির দখলে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করাকে ভূমিতে অনধিকার প্রবেশ বা ভূমি ট্রেসপাস বলে।
অন্যের অঙ্গনে যথার্থ কারণ ছাড়া প্রবেশ করলে ট্রেসপাস সংঘটিত হয়। এ উদ্দেশ্যে বিবাদীর সম্পূর্ণ প্রবেশ প্রয়োজন হয় না। প্রধান ফটকে সামান্যতম অঙ্গুলী প্রবেশই যথেষ্ট। এ ছাড়া জানালায় হাত ঢুকানো, দেওয়ালে হেলান দেয়া, অনিচ্ছাকৃতভাবে বা ভুলক্রমে প্রবেশ করা এ অপকর্মের অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ভাষ্যে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বলপূর্বক কারো কাছ থেকে কোন কিছু গ্রহণ করবে তার শাস্তির মেয়াদ তিন বছর কারাদন্ড অথবা অর্থ দন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। আর এ বলপূর্বক কোন কিছু গ্রহণের মাধ্যমে যদি ভিকটিমের কোন ক্ষতি হয় তাহলে তার শাস্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের কম নয়। আর বলপূর্বক বা জোর করে কাউকে মৃত্যুর ভয় দেখালে তার শাস্তি সাত বছরের কম নয়।
ক্ষতিপূরণের মামলায় বলা হয়েছে যে, জমি পুনরুদ্ধারের মামলা ছাড়াও দখলচ্যুত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারে। বেদখল হতে উদ্ভুত যাবতীয় ক্ষতিসহ দখল উদ্ধার বাবদ যাবতীয় খরচ সে দাবি করতে পারে। আবশ্য বিবাদী ভূমির বা গৃহাঙ্গানের উন্নতিকল্পে খরচ করে থাকলে সেগুলোর জন্য সেট অফ (ঝবঃ ড়ভভ) দাবি করতে পারে কি-না সে বিষয়ে কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত সেই। তবে প্রখ্যাত টর্ট আইন বিশারদ স্যামন্ডের মতামত উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন: যেহেতু বেদখলের ফলে উদ্ভুত ক্ষতিপূরণের জন্য দাবীর দাবি, এটা নীতিগতভাবে পরিষ্কার যে, বিবাদী উক্ত অঙ্গনের যে মূল্য বৃদ্ধি করেছে তা বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিবাদী যদি পুরাতন ঘর ভেঙ্গে নতুন গৃহ নির্মাণ করে থাকে, তবে এটা যথার্থ হবে না যে, বাদী নতুন গৃহের দখল এবং পুরাতন গৃহের মূল্য আদায় করতে পারবে।
স্বাভাবিক যৌনকার্য মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের অন্যতম। এর সমাধান না হলে মানুষ তার জীবনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অবৈধ পন্থায় যৌনকার্য সম্পাদন করা গর্হিত কাজ। কোনো নারী স্বেচ্ছায় নিজেকে দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত করতে পারবে না। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্য কেউ তাকে দিয়ে দেহ ব্যবসায় পরিচালনা করতে চাইলে তাও নিষিদ্ধ। আল-কুরআনে এসেছে, ‘‘তোমরা যুবতীদের দেহ ব্যবসায় লিপ্ত হতে বাধ্য করো না।’’ কুরআনের আরো ঘোষণা, ‘‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। কেননা তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট পথ।’’ মহানবী (স.) বলেন, ‘‘কোন ব্যক্তি মু’মিন থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না।’’ ইসলাম ব্যভিচার ও দেহ ব্যবসায়কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পর্ণোগ্রাফি ছবি তৈরি অশ্লীলতা ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতার পরিচায়ক। তরুণ-যুব-শিশু চরিত্র হনন করাই এর মূল উদ্দেশ্য। ইসলাম যে কোন প্রকার অশ্লীলতার নিকটবর্তী হতেও নিষেধ করেছে। আল-কুরআন বলেন, ‘‘তোমরা কোনো ধরণের প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হয়ো না।’’
চারিত্রিক ও সামাজিক শৃংখলা বিনষ্টকারী উপকরণের ব্যবসা বা ক্রয়বিক্রয় মাধ্যমে অর্থ আয় করাকেও ইসলাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন: ‘‘নিশ্চয় যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা বিস্তার করাকে পছন্দ করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে পীড়াদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ যা জানেন তা তোমরা জান না।’’
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্ বলেন: ‘‘তোমাদের দাসীরা পবিত্র ও সতী-সাধ্বী থাকতে চাইলে দুনিয়ার স্বার্থ লাভের জন্য তাদেরকে ব্যভিচার করতে বাধ্য করো না। তবে তাদের উপর কেউ জবরদস্তি করলে সে ব্যাপারে আল্লাহ্ তাদের উপর ক্ষমাশীল ও দায়ালু।’’
ইসলাম যেনা-ব্যভিচার সমর্থন করে না। এ সমস্ত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহ মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর যারা এমন অশ্লীল কাজে লিপ্ত হবে তাদের উভয়ের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: ‘‘ব্যভিচারিনী ও ব্যভিচারী যেনা করলে উভয়ের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান প্রয়োগে তোমাদের উভয়ের ব্যাপারে নম্রতা দেখানো যাবে না, যদি তোমরা আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাস করে থাক। আর মু’মিনদের একটি দল উভয়ের শাস্তি প্রয়োগ প্রত্যক্ষ করবে। যেনাকারী পুরষ যেনাকারিনী মহিলা যেনাকারী বা মুশরিক পুরুষ ব্যতীত অন্য কাউকে বিবাহ করতে পারবে না। আর এরা মুমিনদের জন্য হারাম।’’ (অসমাপ্ত)