জ্ঞানের প্রসার ঘটে কলমে

112

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে ইসলামের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। সে কারণেই বিজ্ঞান ও শিল্পকতলা চর্চায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোকপাত করা আবশ্যক। দুনিয়াদারীর জীবনকে ইসলাম নিারুসাহিত করেনি, বরং সুস্থ সুন্দর জীবনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে: বল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে নিষিদ্ধ করেছে (৭ঃ৩২৭)? কুরআন মজীদে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যারা বলে, ‘‘হে আমাদের রব! আমাদের ইহকালে কল্যাণ দাও এবং পরকালেও কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে দোযখের আযাব হতে রক্ষা কর’’ (২ঃ২০১)।
সুন্দর জীবন লাভের প্রত্যাশায় মানুষ জগৎ সম্পর্কে জানতে চায়। বিশ্বচরাচরে বিরাজমান সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভের আশায় সে সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালায়। তার নিরলস প্রচেষ্টায় মূল উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত বিশ্বজগতের বিভিন্ন জিনিস থেকে উপকৃত হওয়া। দ্বিতীয়ত মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। কুরআন মজীদে শুধুমাত্র আবিস্কারের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়নি, বরং নিত্য নতুন বিষয় উদ্ভাবনের উপরও যথাযথ জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন- বলা হয়েছে যে, বল, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীগণের পরিণাম কি হয়েছে! তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক (৩০ : ৪২)। আবার এ কথাও উল্লেখ আছে যে, যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ মন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে হে আমাদের রব, তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করনি……(৩ ঃ ১৯১)। জ্ঞান অর্জনের পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেও কুরআন মজীদে স্পষ্ট পথ-নির্দেশ রয়েছে। একটি অশিক্ষিত সমাজে নবী করীম (সা:) জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হয় তাতেই পড়া ও লেখার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। সেখানে কলমের উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলা হয়েছে যে, কলম হল মানুষের জ্ঞান ভান্ডারের নির্ভরযোগ্য হিফাজতকারী।
নবী করীম (সা:)-এর জীবনকালেই মুসলমানগণের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে চিন্তার উন্মেষ ঘটে। পরবর্তীকালে এর উপর ভিত্তি করেই বিকশিত হয় বিভিন্ন বিজ্ঞানের। এর মধ্যে রয়েছে কালাম শাস্ত্র ও তাসাওউফ বিজ্ঞান। মুসলমান বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিভাবান দার্শনিক জন্ম নেন। এদের মধ্যে ছিলেন আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইব্ন সিনা, ইব্ন রুশ্দ এবং আরো অনেকে। তাঁদের মৌলিক দর্শন ও পান্ডিত্যে ইল্ম, কালাম ও তাসাওউফ বিজ্ঞান আরো সমৃদ্ধ হয়। মুসলমানগণই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। প্রাচীন কালেও আইনের প্রচলন ছিল। ক্ষেত্র বিশেষে এগুলো বিন্যস্ত থাকলেও সেসব আইনের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। সে সময়ে আইনের দর্শন ও আইনের উৎস সম্পর্কে কোন আলোচনা হতো না। আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, প্রয়োগ-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে কোন আলোচনা হতো না। আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, প্রয়োগ-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা ছিল অনুপস্থিত। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের আগে এ বিষয়গুলো আইন বিশারদদের বিন্দুমাত্র নাড়া দিত না। মুসলমানগণ আইনের উৎস কুরআন ও হাদীসের আলোকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। তাঁরাই সর্বপ্রথম আইনকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের আগে আর কেউ আইনের মতো এত বস্তুনিষ্ঠ, এত বিমূর্ত বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেননি। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী থেকেই এর চর্চা শুরু হয়। তখন আইনকে বলা হত উসূলে ফিক্হ।
মুসলমানগণ সর্বপ্রথম আইনকে একটি নির্দিষ্ট বিধি ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসেন, এর সঙ্গে জুড়ে দেন দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়টি। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের ইতিহাসের শুরুতে যে সমস্ত চুক্তিপত্র বা আইন প্রণীত হয়েছে, সেগুলোতেও আন্তর্জাতিক ধারাসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে জায়েদ ইব্ন আলী এর মাজ্মু’ এর উল্লেখ করা যেতে পারে। জায়েদ ইব্ন আলী ১২০ হিজরী মুতাবিক ৭৩৭ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। অতীত কালের যে সমস্ত চুক্তিপত্র আমাদের হাতে এসে পৌছেছে সেগুলোর মধ্যে জায়েদ ইব্ন আলী’র চুক্তিপত্রটি সর্বাধিক প্রাচীন। প্রসঙ্গক্রমে আরো উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের হাতে আন্তর্জাতিক আইন স্বতন্ত্র শাস্ত্র বা বিজ্ঞান হিসাবে বিকাশ লাভ করে। এমনকি ১৫০ হিজরীর পূর্বে প্রণীত বিভিন্ন বিবরণ বা রচনায় এতদসংক্রান্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। অবশ্য সে সময়ে আন্তর্জাতিক আইন বলতে স্বতন্ত্র কোন শিরোনাম ছিল না, ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত সিয়ার শীর্ষক শিরোনামে এ আলোচনা স্থান পেয়েছে। ইব্ন হাজর রচিত ‘তাওয়ালী আত-তাসীস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে পথম গ্রন্থ রচনা করেন হযরত ইমাম আবু হানীফা (র:)। তিনি ছিলেন জায়েদ ইব্ন আলী সমসাময়িক। এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে- ক) এখানে সমস্ত বিদেশীকে একই পাল্লায় পরিমাপ করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে কোন রকম তারতম্য বা কারো প্রতি কোনরকম পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি। খ) মুসলমানদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়ে এখানে কোন উল্লেখ নেই বরং গোটা বিশ্বের অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এ গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। বস্তুতপক্ষে ইসলাম নীতিগতভাবে স্থান, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে একটি সুতায় গেঁথে দিয়েছে। সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলেছে একটি জাতি।
মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অবদান রয়েছে তুলনামুলক কেইস ল-এর ক্ষেত্রে। ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বিশেষ কোন আইনের ব্যাপারে কেন এ মতপার্থক্য দেখা দেয় অথবা এ জাতীয় মতপার্থক্যের ফলাফল কি হতে পারে তা নির্ধারণ করা জরুরী হয়ে পড়ে। এখান থেকেই তুলনামুলক কেইস ল-এর উদ্ভব ঘটে। এ বিষয়ের উপর দাবসী এবং ইব্ন রুশদ রচিত পুস্তকগুলো পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। সাইমুরী তুলনামূলক আইন বিজ্ঞান বা আইন পদ্ধতির উপর পুস্তক রচনা করেন। বস্তুতপক্ষে নবী করীম (সা:) ছিলেন এ সংবিধানের রচয়িতা। তিনি যখন মদীনায় নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন এ সংবিধানটি প্রণয়ন করেন। ঐতিহাসিক ইব্ন হিশাম এবং আবু উবায়েদের বর্ণনার মধ্য দিয়ে এটা আমাদের হাতে পৌছেছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বিচার ব্যবস্থা প্রতিরক্ষা প্রভৃতি সকল বিষয় সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক তথা জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে স্পষ্টভাবে। ৫২টি ধারা সম্বলিত এ সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয় ৬২২ খৃষ্টাব্দে। এখানে ইসলামী আইনকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। (ক) ধর্মীয় আচার আচরণ, (খ) যাবতীয় চুক্তি সম্পর্কিত বিষয়সমূহ (গ) শাস্তি সম্পর্কিত বিষয়াদি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইসলাম মানুষের জীবনকে দেখে সামগ্রিকভাবে। এখানে মসজিদ ও দূর্গের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এখানে রাষ্ট্রে বিধিবিধান বা সংবিধানের ধারাগুলো বিবেচিত হয় ধর্মীয় বিধি-নিষেধের অংশ হিসাবে। কারণ এখানে যিনি রাষ্ট্রের প্রধান, তিনিই ধর্মীয় নেতা ও মসজিদের ইমাম। আবার সরকারের রাজস্ব ও অর্থ ব্যবস্থাকে গণ্য করা হয় ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে। কারন, নবী করীম (সা:)-এর ঘোষণা অনুসারে সালাত, ইসলাম ও হজ্জের মতো এটাও (যাকাত) ইসলামের একটি স্তম্ভ। অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক আইন দন্ডবিধির একটি অংশ। আর লুটতরাজ, ডাকাতি, রাহাজানি, আইন বা চুক্তি অমান্যকারীদের গৃহীত ব্যবস্থাকে গণ্য করা হয় জেহাদের মর্যাদায়। ইতিহাস এবং সমাজ বিদ্যায় মুসলমানদের অবদান প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে (ক) তথ্য নির্ভর এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, (খ) নানান প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিচিত্র ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। ইসলামের ইতিহাস অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। এখানে পৌরাণিক কাহিনী বা কল্পলোকের কোন স্থান নেই। ইসলামের ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ম ও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। হাজার বছর পরেও যাতে এর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন না ওঠে তা নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য।