আহত প্রেম

109

॥ আবু মালিহা ॥
(১)
সবুজ শ্যামল গ্রাম। পাশেই বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী। নামটি তাড়িনী। ডিঙ্গি নায়ের দোলায় তরঙ্গে আরও নাচন দিয়ে ছুটে চলে। ছোট ছোট এসব ডিঙ্গি নায়ে অনেকেই তাদের সখ আর আনন্দের খেলায় উদ্দীপনা জাগায়। গ্রামের পুরো এলাকার চঞ্চল বালক বালিকারা জলাঙ্গীর ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে উন্মত্ত কোলাহলে। নয়নাভিরাম উচ্ছলতায় মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় প্রকৃতির নৈসর্গিক পরিবেশে। নদীর দু’পাশেই ছোট ছোট কুঁড়েঘর ও ডোল পাতায় ছাওয়া ছোট্ট কুটিরগুলো ছবির মতন ফুটে উঠেছে আকাশ গাঙের নীচে। অপরূপ! নয়নজুড়ানো মুগ্ধতা আর প্রকৃতির আনন্দ বিলাস মনের ভিতর নব তরঙ্গের ঢেউ জাগিয়ে দেয় তাড়িনীর ছুটে চলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। এ যেন চিরাচরিত গাঁ-গেরামের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক রূপ। এরই মাঝে ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম দোলাপুর। বালক-বালিকাদের উচ্ছল আনন্দে সত্যিকার ভাবেই গ্রামটিকে দোলা দিয়ে যায়। আনন্দের বন্যা ছুটে চলে এ এলাকার সহজ সরল মানুষের দৈনন্দিন জীবনে।
দোলাপুরের একটি ছেলে। নাম শিশির। বাবা মিশির এবং মা তিশার আদরের নয়ন মনি। ছোটবেলা থেকেই স্নেহ আর আদর দিয়ে বড় করে তুলেছেন চোখে চোখে রাখা বাবা মায়ের এ শিশু সন্তানটি বেশ চটপটে ও প্রাণোচ্ছল। সর্বদা হাসি লেগেই থাকে তার চোখে মুখে। তার সহপাঠিরা তাকে কখনো ঝগড়াঝাটি বা দুষ্টমি করতে দেখেনি। তবে দৌঁড়ঝাঁপ এবং খেলাধূলায় বেশ দক্ষ। মা তার বরাবরই তাকে সাবধান থাকতে বলেন, বেশী দৌড়ঝাঁপ না করতে। শরীর খারাপ হবে, ব্যথা পাবে অথবা নদীতে পড়ে ডুবে যাবে ইত্যাদি বলে। কিশোর বয়স বলে কথা। বয়স তরঙ্গে সে কথা কে মানতে চায়। এই বয়সে যা চায় সেটা সব ছেলেমেয়েরাই করে। স্বাভাবিক ভাবেই দুরন্তপনা তাদের স্বভাব হয়ে পড়ে।
এমনি করে দিন চলছে। পাশের গ্রামেই আছে একটি স্কুল। তাতেই ভর্তি হতে হয় দু’তিন গ্রামের ছেলেমেয়েদের। কাছে আর কোথাও স্কুল বা মাদরাসা নেই। নন্দীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বেলা ১০টায় স্কুল শুরু হয়। বিকেল ৩টায় শেষ হয়। ছুটির ঘন্টার পর স্কুলের আঙিনা গলিয়ে সবাই যার যার বাড়ীর দিকে রওয়ানা হয়। শিশিরের বয়স সবেমাত্র ৬তে পড়েছে। বাবা মা অনুভব করলেন ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এখন তো শুধু খেলার বয়স। তবে স্কুলে ভর্তি করলে খেলাধূলাটা কমবে এবং পড়াশুনার দিকে মনেযোগী হবে। এই ভেবে ছেলেকে নিয়ে বাবা মিশির স্কুলে রওয়ানা দিলেন। একমাত্র ছেলে বড় হয়ে পরিবারের হাল ধরবে এই আশায় এখন থেকেই বাবা মা তার পড়াশুনার দিকে মনোযোগ দিলেন।
প্রায় ৩ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে শিশিরকে নিয়ে বাবা মিশির নন্দীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে চারদিক তাকাতে লাগলেন। গ্রামীণ পরিবেশে স্কুলের আঙ্গিনা এবং লম্বা স্কুল ঘরটি আসলে খুবই সুন্দর। বিশ-পঁচিশ জন ছেলেমেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। দশটায় ক্লাস শুরু হবে তাই তাদের ক্লাস শুরুর আগে খেলাধূলা করছে। বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। পিয়ন এসে ঘন্টা বাজিয়ে ক্লাস শুরুর ঘোষণা দিয়ে গেল। স্কুলের প্রাঙ্গণ খুব মসৃণ নয় বলে আপাতত এসেম্বলী শুরু করা যায়নি। তবে কিছুদিনের মধ্যে সমতল করে শরীর চর্চার ক্লাসটিও চালু হয়ে যাবে বলে প্রধান শিক্ষক বললেন। ইতোমধ্যে প্রধান শিক্ষক জহুর আলীর সাথে কথা হয়েগেছে শিশিরের বাবা মিশির এর সাথে। খুব করে বললেন ছেলের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের কথা। দূর গ্রাম থেকে এসে পড়াশুনা করা কষ্টকর বটে। তবুও তিনি তার ছেলেকে মানুষ করার জন্য প্রতিদিনই স্কুলে দিয়ে যাবেন বলে অঙ্গিকার করলেন। প্রধান শিক্ষক জহুর আলীর কথা শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি তো চানই গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো মানুষ হোক এবং উন্নত হোক গ্রামের চালচিত্র। অবহেলায় আর অনাদরে গ্রামগুলো পিছিয়ে না থাকে। যেখানে কবির ভাষায় গ্রামগুলো ‘শ্যামল ছায়ার শান্ত সুনিবিড়। ছোট ছোট গ্রামগুলো। হ্যাঁ তাই। তবে এখন আর গ্রামগুলো আগের মত নেই। গ্রামে যেন দিনে দিনে কুৎসিত মানুষগুলোর ভিড় বাড়ছে। সহজ সরল উদার মনের মানুষগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। হিংসাত্মক মনোভাব একে অন্যের ক্ষতি সাধনে যেন এখন লিপ্ত। এবং হানা হানি মারামারি করে অশান্ত করে তুলছে কবিত্বের কল্পনার সেই ছায়া সুনিবিড় গ্রামগুলো। তবুও জহুর আলীর আশা একদিন আবারও গ্রামগুলো সুন্দর হবে। শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ বড় হয়ে গ্রামের চেহারা পাল্টে দিবে। সেই ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে তার এই প্রচেষ্টা। স্কুলকে সুন্দর করা। ছাত্রছাত্রী কালেকশন করা এবং তাদের শিক্ষা দিয়ে দেশের সফল এবং সার্থক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। যাকে বলে মহৎ কাজ। নিজের স্বার্থ চিন্তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তার এই ব্রত। এভাবেই স্কুল কার্যক্রম চলছে। ৩ জন শিক্ষক ও শিক্ষিকা, জহুর আলী প্রধান। অন্য দু’জন শিক্ষক এবং শিক্ষিকা। আরও একজন শিক্ষিকা যোগ দিবেন বলে আশা করছেন প্রধান শিক্ষক। আর তখনই ক্লাস মেনটেইন করতে আর কোন অসুবিধা হবে না। (অসমাপ্ত)