বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি, নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

82

সুনামগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জে বন্যার পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে Flood pic 1সুনামগঞ্জের নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার লক্ষাধিক মানুষ। তলিয়ে গেছে পথ, ঘাট, ফসলি জমি। ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় জেলার ৭টি উপজেলা প্রত্যেকটি গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা জেলা শহরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, রবিবার সকাল ১০টায় সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্টে ১১ সে.মি. পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮১ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্র জানায়, রোপা আমনের ৬শ ৬৫টি হেক্টর বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও প্রায় ৪ হাজার হেক্টর রুপা আমনের ফসল তলিয়ে গেছে। বালিজুড়ী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মিলন রায় জানান, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে রক্তিনদীর পাশ্ববর্তী আনোয়ারপুর বাজার ব্রীজ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়াও আনোয়ারপুর ও শক্তিয়ারকলা সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত হয়ে পাকা রাস্তার ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার ৬টি উপজেলার বাজারগুলোর দোকানপাট তলিয়ে গিয়ে বাজার হাট বন্ধ রয়েছে। তবে প্লাবিত হওয়া এলাকাগুলোতে খেটে খাওয়া মানুষেরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাদদেশসহ ভারতে বর্ষারোহী মৌসুুমি বায়ু জোরালো রয়েছে। সীমান্তবর্তী নদ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে বেকার হয়ে পড়ছে জেলার লক্ষাধিক মানুষ। বন্যার অবনতি হয়ে বাড়ি ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। স্থানীয়রা জানিয়েছেন এমন দুর্যোগের সময় জনপ্রনিধিরা দুরে সরে দাড়িয়েছেন। তারা কেউই পানিবন্দি কিংবা আশ্রয়হীন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তাহিরপুর উপজেলার কাদির মিয়া বলেন, ভোট দেওয়ার সময় মেম্বার, চেয়ারম্যানরা বাড়িতে এসে ধরে। আর আমরা বিপদে পড়লে তারা সাহায্যতো বড় দুরের কথা একবার আইসা দেখারই সুযোগ পায়নি। তিনি আরো বলেন, বন্যার কারনে আমরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি। এখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তা পাইনি। তবে জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বন্যায় পানিবন্দী মানুষের জন্য জেলার ১১ টি উপজেলায় ৩ মেট্রিকটন করে জি.আর চাল ও শুকনো খাবারের জন্য ১০ হাজার করে জি.আর ক্যাশ দেয়া হয়েছে। তবে দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।  সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস জানান, ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢল নেমে এসে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮১ সে.মি উপর দিয়ে বইছে। জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জে বন্যার পরিস্থিতি আরো অবনতি হচ্ছে। তবে বন্যায় পানিবন্দী মানুষের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এদিকে চেয়ারম্যান, মেম্বাররা কোনো সহায়তা না দিলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন ব্যাক্তিগত ভাবে তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পানিবন্দি মানুষকে শুকনো খাবার ও ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন।
ছাতক থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ছাতক উপজেলার নিম্মাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। শহর ভিত্তিক ছাড়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পানিবন্দী অবস্থায় নির্ধারিত দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে। পানিবন্দী মানুষের জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র খোলার খবর এখনও পাওয়া যায়নি। ৭-৮দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর ও নোয়ারাই ইউনিয়নের অধকাংশ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। গ্রামীন রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। এ ছাড়া ছাতক সদর, কালারুকা, চরমহল¬া, দোলারবাজার, ভাতগাঁও, উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, সিংচাপইড়, গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাও, ছৈলা-আফজলাবাদ ইউনিয়নসহ পৌরসভার নিম্নাঞ্চল প¬াবিত হয়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার, চেলা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর পানি প্রবল বেগে প্রবাহিত হওয়ায় নৌপথে ছোট-ছোট ফেরী নৌকা চলাচল প্রায় বন্ধ গেছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দু’য়েক দিনের মধ্যেই ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ারও আশংকা রয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় শতাধিক হেক্টর রোপনকৃত আমন জমি ও বীজতলা। কয়েকটি ষ্টোন ক্রাসার মিল, পোল্ট্রি ফার্ম ও মৎস্য খামারে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। শাক-সবজির বাগানেও পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে কৃষকদের। ইসলামপুর ইউনিয়নের রতনপুর-মণিপুরীবস্তির বেড়িবাধ ভেঙ্গে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদীপাড় সংলগ্ন ছনবাড়ি-রতনপুর সড়ক, ছনবাড়ি-গাংপাড়-নোয়াকোট সড়কের বিভিন্ন স্থান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া নদী ভাঙ্গনে হুমকির মুখে পড়েছে কয়েকটি গ্রাম। জামুরা, চানপুর, নোয়াগাঁও, ভাসখলা, করচা, গোয়ালগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাতায়াতের সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঝুকি নিয়ে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা দিচ্ছে। বৈশাকান্দি এফআইভিডিবি স্কুল, নোয়ারাই ইউনিয়নের চরভাড়া মাদ্রাসা, লামাপাড়া ব্র্যাক স্কুলে বন্্যার পানি প্রবেশ করেছে। ইসলামপুর ইউনিয়নের রতনপুর, নিজগাঁও, গাংপাড়, নোয়াকোট, বৈশাকান্দি,বাহাদুরপুর, ছৈদাবাদ, রহমতপুর, দারোগাখালী, পৌরসভার হাসপাতাল রোড, শাহজালাল আবাসিক এলাকা, শ্যামপাড়া, মোগলপাড়া তাতিকোনা, বৌলা, লেবারপাড়া নোয়ারাই ইউনিয়নের বারকাহন, বাতিরকান্দি, চরভাড়া, কাড়–লগাঁও, লক্ষীভাউর, চানপুর, মানিকপুর,গোদাবাড়ী, কচুদাইড়, রংপুর, ছাতক সদর ইউনিয়নের বড়বাড়ী, আন্ধারীগাঁও, মাছুখালী, তিররাই, মুক্তিরগাও, উত্তর খুরমা ইউনিয়নের আমেরতল, ঘাটপার, গদালমহল, রুক্কা, ছোটবিহাই, এলঙ্গি, রসুলপুর, শৌলা, চরমহল¬া ইউনিয়নের ভল¬বপুর, চুনারুচর, চরচৌলাই, হাসারুচর, প্রথমাচর, সিদ্ধারচর, চরভাড়ুকা দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের হরিশরণ, হাতধনালী, রাউতপুর, ধনপুর, চৌকা, রামচন্দ্রপুর, হলদিউরা কালারুকা ইউনিয়নের রামপুর, মালিপুর, দিঘলবন, আরতানপুর, রংপুর, মুক্তিরগাও, ভাতগাঁও ইউনিয়নের জালিয়া, ঘাঘলাজুর, হায়দরপুর, বাদে ঝিগলী, সিংচাপইড় ইউনিয়নের গহরপুর, মহদী, গোবিন্দগঞ্জ পুরান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র দাস জানান, বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় পানি প্রবেশ করেছে। প্রকৃতির এ বৈরী পরিবেশও নিয়মিত দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তা কেএম বদরুল হক জানান, বন্যার পানিতে এখন পর্যন্ত রোপনকৃত আমন জমি ৫৬ হেক্টর ও ২৫ বীজতলা তলিয়ে গেছে।
নিজাম নুর জামালগঞ্জ থেকে জানিয়েছেন : গেল কয়েক মাস আগে অকাল বন্যায় জামালগঞ্জ হাওর পারের কৃষকেরা তাদের একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে অভাব শেষ হতে না হতেই টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলে প্লাবিত হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রাম। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণও উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢল জামালগঞ্জে প্রবাহিত সুরমা নদী ও হাওরের পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পানি বন্দী হয়ে পড়েছে উপজেলার ৬ ই্উনিয়নের প্রায় শতাধিক গ্রাম। অতিমাত্রায় পানি বৃদ্ধি পাওয়া উপজেলার অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান স্থগিত। উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়,বন্যা পরিস্থিতি অনুকূলে তাকায় উপজেলার সবকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।বন্যার পরিস্থিতি অবনতি ফলে উপজেলার আপন রোপন, বীজ ও সবজী ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়। সুরমার পানি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় সাচনা বাজার সহ উপজেলার বেশকটি ছোট রড় বাজারের গলিতে  হাঁটু অবধি পানি বিরাজ করছে ফলে জনজীবনে অধিক ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে জামালগঞ্জের বিপন্ন জনগণ। সরজমিনের উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুড়ে দেখা যায়, শতাধিক গ্রামের প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে পানির উপর ভাসমান জীবন যাপন করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উপজেলা সদর সহ জেলা সদরে পৌছার অধিকাংশ রাস্তাই পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।
বিশ্বনাথ থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : গত এপ্রিল মাসে অকাল বন্যার পর এবার বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে টানা ৪দিনের ভারি বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল আর সুরমা নদীর পানি বাড়ায় বিশ্বনাথে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। তলিয়ে গেছে প্রায় ২৫টি গ্রামের রাস্তাঘাটসহ ১২০ হেক্টর আমন ক্ষেত। তবে, গতকাল রবিবার পর্যন্ত কোন ঘর-বাড়িতে বানের পানি না উঠলেও সুরমা নদীর দু’তীর প্লাবিত হয়ে লামাকাজি ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি গ্রামের রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর মধ্যে লামাকাজির মাহতাব পুর, মির্জারগাঁও, সোনাপুর, উদয়পুর, পাঠানরগাঁও, মিরপুর, ভুরকী, ইসবপুর, হামজাপুর, মোল্লারগাঁও, দোকানীপাড়া, আতাপুর, হাজরাই, মান্দাবাজ, শাহপুর, মাধবপুর, সাঙ্গিরাই, রসুলপুর, মাখরগাঁও, হেকুরা গাঁও, সাহেব নগর। গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রবিবার পর্যন্ত অজর ধারায় বৃষ্টিপাতের কারণে উপজেলার বিভিন্ন নদী-নালা, খাল-বিল-ও হাওরে পানি ক্রমেই বৃদ্দি পাচ্ছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে স্থানীয় চেয়ারম্যান কবির হোসেন ধলা মিয়া ও ইউপি সদস্য এনামুল হক সরকারিভাবে বরাদ্দের দাবি জানিয়ে বলেন, বন্যার পানি ক্রমেই বাড়ছে, ফলে ধীরে ধীরে এ ইউনিয়নের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
বন্যাপরিস্থিতি পরিদর্শনের কথা জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিতাভ পরাগ তালুকদার বলেন, ভয়ের কোন কারন নেই। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসন প্রস্তত আছে।