স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহিত্য আন্দোলনের ভূমিকা শীর্ষক জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন ॥ প্রসঙ্গ কথা

173

মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী

স্বাধীনতা সংগ্রাম কারো একদিনে হয়নি। স্বাধীনতা সংগ্রাম পৃথিবীর প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী জাতিকে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করার পরই সে জাতির মুক্তি লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্র কাননে যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার পর-পরই সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। যা অল্প কথায় লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহিত্য আন্দোলনের ইতিহাসও দীর্ঘদিনের।
বিংশ শতাব্দির দোড় গোড়ায় কলিকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও পূর্ব বাংলায় বঙ্গীয় মুসলীম সাহিত্য পরিষদের ভূমিকা কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখার নয়।
মূলত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন ও বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মাধ্যমে-আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা জাগানো হয়েছিল, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব সম্মেলনের মাধ্যমে যারা শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাদেরকে স্মরণ করছি। আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মহোদয়কে। স্মরণ করছি পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়কে, স্মরণ করছি মহান জ্ঞানতাপস বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, স্মরণ করছি শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে, স্মরণ করছি মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীসহ যারা এসব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তাদেরকে।
আজ যারা ভিতরে ভিতরে বাংলাদেশ প্রীতি ভুলে পাকিস্তান প্রীতিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, মুসলিম লীগের আসল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যা ১৯৪০ এর লাহোর অধিবেশনে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক মহোদয়ের লাহোর প্রস্তাবের দলিল দেখলেই স্পষ্ট দেখা যাবে। ভারত বর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা দিয়ে আলাদা আলাদা দুটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। পূর্ব বলতেই আমাদের বাংলাদেশ।
১৯৪৭ পরবর্তী ৫২’র যে ভাষা আন্দোলন তাও মূলত সাহিত্য আন্দোলন। কারণ ভাষা রক্ষা না পেলে সাহিত্য রক্ষা পায় না। ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৮ সালে কাগমারিতে যে ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলন হয়েছিল তাও একটি শক্তিশালী সাহিত্য আন্দোলন। কারণ সংস্কৃতি হচ্ছে সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনেক ভেবে চিন্তে সেই সম্মেলনের নামকরণ করেছিলেন আফ্রো-এশিয়ান সাংস্কৃতিক মহাসম্মেলন। যাতে রাজনীতির অজুহাত এনে সম্মেলন বানচাল না হয় তাই এই প্রয়াস। যে সম্মেলনে পৃথিবীর বহুদেশের অতিথিরা এসেছিলেন, সেই সম্মেলনের মাধ্যমে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে আস্সালামু আলাইকুম বলে বিদায় জানিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমসহ অসংখ্য শিল্পীরা দেশের গান গেয়ে জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিলেন। যাহা আমাদের স্বাধীনতার চালিকা শক্তিতে রূপ নিয়েছিল।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক যে, সাহিত্য ভিত্তিক চলচিত্র নির্মাণ করেও পৃথিবীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ‘জীবন থেকে নেওয়া’ এবং নবাব ‘সিরাজ উদদৌলা’ এ দুটি ছবিও কাজ করেছিলো জাতীর শিরায় শিরায়।
মধ্যযুগের কয়েকজন কবির নাম এখানে স্মরণ করছি। ষোড়শ শতাব্দির কবি সৈয়দ সুলতান বলেছেন-যারে যেই ভাষে করিলো সৃজন,
সেই ভাষ হয় তার অমূল্য রতন।
কবি আব্দুল হাকিম:- যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী,
সেই সব কাহার জন্ম নির্নয় ন জানি।
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মন ন জুড়ায়,
নিজ দেশ ত্যাগে কেন বিদেশ ন যায়।
মাতাপিতামহ ক্রমে বঙ্গতে বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।
মাইকেল মধুসুদনঃ পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।
রবি ঠাকুরঃ আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,
তুমি কি অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
নজরুলঃ নমঃনমঃনমঃ বাংলাদেশ নমঃ কি মনরোম, কি মধুর।
লতিফ শাহঃ শোন বলি সারাসার বাংলাদেশের অধিকার।
নায়েবর রাসুল-আমার বাবা শাহ্ জালাল।
উপরে উল্লেখিত কবিদের পদাবলীতে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের কথা জোরালোভাবে বলা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার প্রেরণা শক্তি যা অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উপরোল্লিখিত বিষয়ের উপর জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের স্বপ্ন, আমার দীর্ঘদিনের-লালিত একটি স্বপ্ন। দেশের নানা প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে উদ্যোগ নেওয়ার সাহস হয়নি বিগত দিনে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই সেই উদ্যোগ গ্রহণ করি বিগত ২০০৯এর ১৯এ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউন্সে প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। আমাদের উৎসাহ দাতাদের অন্যতম ছিলেন, বিটিভির প্রয়াত সাবেক ডিজি কবি কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী, সাবেক সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক,মোস্তফা শহীদ, সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী ও বর্তমান মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজ্জামেল হক।
আমাদের পাশে যে সব ব্যক্তিরা জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে সময়ে সময়ে আপনজনের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা হচ্ছেন মেজর জেনারেল কে.এম. সফিউল্লাহ (অব.) বীরোত্তম, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ পাটোয়ারী, কবি মুহম্মদ আব্দুল খালেক, সাংবাদিক খন্দকার মোজ্জাম্মেল হক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব এটি.এম গিয়াস উদ্দিন, কবি আসলাম সানি, কবি রবীন্দ্র গোপ, কবি নাহিদ রোকসানা, প্রয়াত সৈয়দ হাবিব রহমান হিরণ, কবি ড. শহিদুল্লাহ আনসারী, কবি মহিউদ্দিন আকবর, কবি শাহরিয়ার মমতাজ, ছড়াকার তাজুল ইসলাম বাঙালি, কবি দেলোয়ার মুহাম্মদ, কবি শামিমরুমি টিটন, এ্যাড. মোস্তাক আহম্মেদ প্রমুখ।
২০০৯ এর ১৯ মার্চের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় সমাজ কল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ।
২০১০ এ দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় খামারবাড়ীস্থ গিয়াস উদ্দিন মিল্কী অডিটরিয়ামে। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমপি ৩য় ও ৪র্থ সম্মেলন হয় পাবলিক লাইব্রেরী সেমিনার হলে, ৫ম ও ৬ষ্ঠ সম্মেলন হয় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির উপরের তলাস্থ খাজা নিজাম উদ্দিন মিলনায়তনে। এবার দেশে নানা অস্থীতিশীল পরিবেশ থাকায় মার্চ মাসে প্রোগ্রাম করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আমি অসুস্থ থাকার কারণেও উদ্যোগ নিতে পারিনি। চলতি ১১নভেম্বর ২০১৫ এ আমরা ৭ম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছি শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে। এবারের অনুষ্ঠানের নির্ধারিত প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমীর চেয়ারম্যান প্রফেসর ইমেরিটার্স অধ্যাপক. ড. আনিসুজ্জামান স্যার’কে হত্যার হুমকি প্রদান করায় নিরাপত্তাজনিত কারণে স্যার অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। আমরা হুমকি প্রদানকারীর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি। সে সাথে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করছি। এবারে আমরা ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন করেছি, যা বর্তমান সময়ে একান্ত প্রয়োজন। কর্মসূচী হচ্ছে কবিতা আবৃত্তি, রচনা ও উপস্থাপনা বিষয়ক কর্মশালা। আমিও একদিন থাকবো না ধরাধামে, নিয়তির বিধানে চলে যেতে হবে। বাংলাদেশ পোয়েটস্ ক্লাব ও বাংলাদেশ পল্লীসাহিত্য গবেষণা পরিষদের কার্যক্রম যাতে জাতির শিল্প সাহিত্যের পাতায় অমর গাথা হয়ে থাকে সে প্রত্যাশা করছি।
এবারে আমরা একজন মানুষকে স্মরণ করছি আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। তিনি হচ্ছেন বাংলাবাজারস্থ বিউটি বোর্ডিং এর সত্বাধিকারী স্বর্গীয় প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা, তিনি বাঙালি কবিদের সাহিত্যানুষ্ঠানে সক্রিয় সহযোগীতা করতেন তার বোর্ডিং এ আড্ডা জমিয়ে। যেখানে রয়েছে আমাদের কবি শামসুর রাহমানের নাম। শামসুর রাহমান যে রুমে বসে আড্ডা দিতেন তার নাম সেখানে সুধী কক্ষ নামে এখনও স্টিকার লাগানো আছে। ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার অপরাধ তিনি বাঙালি কবি-লেখকদের তার বোর্ডিং-এ আড্ডা বসিয়ে অনুষ্ঠান করার সহযোগীতা করতেন। বিউটি বোর্ডিং এ বন্ধু সভা এখনও হয়। আমরা এবারের অনুষ্ঠানে সেই মহান ব্যক্তির প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করছি। সেই সাথে আমাদের মহান কবি শামসুর রহমান মহোদয়কে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে। বিগত ২০০৯ থেকে যারা জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের সাথে জড়িত তাদের সকলের মঙ্গল কামনা করছি। তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
(প্রবন্ধটি ৭ম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ হিসেবে কবি ফাতেমা ইসরাত রেখা কর্তৃক পঠিত হয়)