আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি তোফাজ্জল হোসেন ‘একুশের গান’ কবিতায় এভাবেই মাতৃভাষা বাংলাকে স্মরণ করেছেন। ‘রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি/একুশে ফেব্রুয়ারি/দৃঢ় দুই হাতে রক্ত পতাকা উর্ধে তুলিয়া ধরি/একুশে ফেব্রুয়ারি/তোমাকে স্মরণ করি।’ মাতৃভাষা আন্দোলন একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষায় বাংলাভাষা ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহি:প্রকাশ ঘটে। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি এ আন্দোলন চূড়ান্তরূপ ধারণ করলেও বস্তুতপক্ষে এর বীজবপন হয়েছিল অনেক আগে। এর প্রতিক্রিয়া এবং ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, যার মধ্য দিয়ে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা লাভ করেছি আমরা।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয় কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ’৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়, বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বেআইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
গোলাম কুদ্দুছ তার ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ’৮৯ সালের ১৯ এপ্রিল ঢাবির নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটরত অবস্থায় যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কয়েক মাস পরে মুক্তি পেলেও ’৫০ সালের ১ জানুয়ারি তাকে আবার রমনা গেট থেকে গ্রেফতার করা হয়। ’৪৯ সালের ১১ অক্টোবর আরমানিটোলা ময়দান থেকে জনসভা শেষে ভুখা মিছিল বের করার অপরাধে পুলিশ তাকে খুঁজছিল। শেখ মুজিবকে কারাগারে রাখার প্রতিবাদে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ’৫১ সালের ২৯ নবেম্বর ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল স্থানান্তর করা হয়। ’৫১ সালের ১ ডিসেম্বর শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রসভা হয়। শেখ মুজিব সব সময় ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের অগ্রভাগে থেকেছেন।
পাকিস্তান বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুটি আগে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উর্দুভাষা কিছুসংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব ওয়াকার-উল মুলক মৌলভী, মৌলভী আবদুল হক প্রমুখের চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের ‘লিংগুয়াফ্রাঙ্কায় উন্নীত হয়। উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারেরও অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষা অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো আর্য ভাষা পালিপ্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবী ও তুর্কীর ঘনিষ্ঠ প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দিল্লী সুলতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্যকালে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়। পারসিক-আরবী লিপির উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যেখানে হিন্দী ও দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান বিবেচনা করা হতো।
বশির আল হেলাল তার ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, পাকিস্তানী প্রভুরা পূর্ব-বাংলার সাংস্কৃতিক অবদমন ঘটাতে চেয়েছিলেন। তার একটা প্রতিক্রিয়া ও বিস্ফোরণ রূপে ভাষা-আন্দোলন হয়েছিল কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অবদমনের পেছনে মূল অভিসন্ধি ছিল অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ। উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে কিন্তু বাংলার মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল। বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দোভাষাসমূহ থেকে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্য ভাষা, যা বাংলার নবজাগরণকালে বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন, আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিস্তার তখন থেকেই বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের আগেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন, যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলমাদের ‘লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা’ মনোনয়নের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলিম লীগ ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি রাজনৈতিক দল, যা ভারত বিভাজনকালে পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা নানা চড়াই-উতরাইয়ের মাধ্যমে। পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যা বিষয়ে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়, বলা হয় বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে। ’৫০ সালের ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। তবে এটি ’৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি। এখানে ভাষা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়। যেখানে তারা বাংলাকে আরবী অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেছিলেন। ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণ ঘটে। বায়ান্নর ৪ ফেব্রুয়ারি নবাবপুরে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে ছাত্রদের মিছিল।
ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগি বিষয়ের পুনরায় জোরালো হওয়ার পেছনে ’৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দীন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় এসে ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহর কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রসারিত তার ভাষণে তিনি আরও বলেন, যে কোন জাতি দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। নাজিমুদ্দীনের ওই বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা, ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা, ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেন। পরে তারা তাদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) দিকে অগ্রসর হলে পরদিন ৩১ জানুয়ারি ঢাবির বার লাইব্রেরি হলের সভায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্র্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। সভায় আরবী লিপিতে বাংলা লেখার সরকারী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে ৭ ফেব্রুয়ারি শান্তিনগরের একটি বাড়িতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কিছু নেতাকর্মী বৈঠক করার সময় পুলিশ সেখানে হানা দিয়ে ৮ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ৭ জনের নাম দৈনিক আজাদে ছাপা হয়েছিল। এরা হলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, সাদেক খান, আবদুল লতিফ, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী ও মজিবুল হক। আরেকজনের নাম জানা যায়নি।
পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাবি ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবী লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকারে বাধ্য হবে ’৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়।