কাজিরবাজার ডেস্ক :
আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। জঙ্গিরা ড্রোন তৈরি করে বিস্ফোরক যুক্ত করার মাধ্যমে বড় ধরনের নাশকতা ও জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করছে এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এরপর সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধ শেষে আশির দশকের আফগান ফেরত সেই ১১১ যোদ্ধার তালিকা হালনাগাদ করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি, হুজি এবং আনসার আল ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াত-শিবিরের প্রতিও বিশেষ নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ভারত হয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান গমনেচ্ছুদের বিশেষ করে যুবক শ্রেণীদের ক্ষেত্রে বিমান বন্দর ও স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশনকে সতর্ক নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সীমান্তে বাড়ানো হয়েছে সতর্কতা ও নজরদারি। রোহিঙ্গা শিবির, কওমি মাদ্রাসা এবং বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপকে রাখা হয়েছে বিশেষ পর্যবেক্ষণে। বাংলাদেশ থেকে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যুবক শ্রেণী আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নজরদারির নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, আফগাস্তিানে তালেবান উত্থানের বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন খবরের ভিত্তিতে কঠোর নজরদারি ও সতর্কতা জারির পর নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান প্রশিক্ষক ও বোমা প্রস্তুতকারী জাহিদ হাসান ওরফে রাজু ওরফে ইসমাঈল হাসান ওরফে ফোরকানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জাহিদ ড্রোন বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। ড্রোনের সঙ্গে বিস্ফোরক যুক্ত করে কোন জায়গায় আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পাওয়ার পর উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গি সংগঠন বিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, আশির দশকে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন শতাধিক তরুণ-যুবক। এর একটি বড় অংশ কওমি মাদ্রাসার উগ্রপন্থী শিক্ষক। আফগানিস্তানে তারা গেরিলা যুদ্ধ এবং ভারি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়। সেই আফগান ফেরত যোদ্ধাদের উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) আল ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। হুজিকে নিষিদ্ধ করা হয় ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর। গত ৮ বছর ধরে আনসার আল ইসলাম নামে সক্রিয় হুজি সদস্যরা। সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানে নয়া তৎপরতা শুরু করেছে তারা। এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ফের আফগানিস্তানমুখী হচ্ছে। তাদের এ কাজে উৎসাহ দিচ্ছে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) শীর্ষ স্থানীয় নেতারা। সাম্প্রতিক আফগান পরিস্থিতি এবিটির জঙ্গিদের কাছে বাংলাদেশে আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে। তারা বিভিন্ন এ্যাপসের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। এমনকি কিছু ইসলামী দল তাদের সমর্থন দিচ্ছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যুবকদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুপ্ত বাসনা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তালেবানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা নতুন নতুন হামলার পরিকল্পনা করছে। এর আগে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নব্য জেএমবির সদস্যরা দেশে বেশকিছু হামলা চালিয়েছে, যার পুনরাবৃত্তি করতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে জঙ্গিরা।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশী মৃত্যুবরণ করেছিল দুজন। যুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে ১১১ জন বাংলাদেশী ‘মুজাহিদ’ দেশে ফেরত আসে। এদের মধ্যে ১৫ জন শিক্ষক এবং মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। মামলার পলাতক আসামি একজন। নিখোঁজ আছেন ১৮ জন। বিভিন্ন মামলায় জেলহাজতে আছেন চারজন। মসজিদের ইমাম/খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ১০ জন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে ব্যবসা এবং কৃষিকাজ করছেন ২১ জন। মারা গেছেন আটজন। আমেরিকায় অবস্থান করছেন দুজন। সৌদি আরবে আছেন সাতজন। ইতালিতে রয়েছেন দুজন। আরব আমিরাতে সস্ত্রীক অবস্থান করছেন একজন (আল মারকাজুল ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও খেলাফত মজলিসের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত)। দুবাই/বাহরাইনে অবস্থান করছেন দুজন (আল মারকাজুল ইসলামীর ভাইস চেয়ারম্যান)। এছাড়া লন্ডনে অবস্থান করছে একজন। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে দুজনের (মাওলানা শায়খ আব্দুর রহমান ও মুফতি হান্নান)। এতিমখানার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন। অসুস্থ এবং বৃদ্ধাবস্থায় দিনাতিপাত করছেন দুজন। জঙ্গি মামলার আসামি হলেও জামিনে আছেন একজন। নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন। ডাক্তারি বা কবিরাজি করছেন দুজন। তাছাড়া পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে একজনের নাম রয়েছে পুলিশের খাতায়।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মাদ্রাসার ছাত্ররা গড়ে তোলেন তালেবান নামে সংগঠন। তার নেতৃত্ব দেন মোল্লা ওমর, যিনি ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ লাভ করেন। তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউল হক। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তালেবানদের জিহাদী মতাদর্শ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। সশস্ত্র উগ্রবাদী গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও প্রথমে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এবং পরে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রধানত পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তালেবানরা জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তারা এতটাই শক্তি অর্জন করেন যে, ১৯৯৬ সালে নজিবুল্লাহর সরকারকে হটিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেন। তালেবানরা শরিয়া আইনকে তাদের নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে কট্টর শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। সেখানে নারীদের অধিকার কেড়ে নেয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকা- বন্ধ করা, পুরুষদের এক মুঠো দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করার মতো ইসলামি শাসন কাঠামোর নামে জবরদস্তিমূলক অনেক কিছু প্রবর্তন করা হয়। তালেবানরা ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দিতে থাকেন। বিন লাদেনের সঙ্গে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সৌদি বংশোদ্ভূত এ জঙ্গি নেতা আফগানিস্তানে বসবাস করতে থাকেন। তালেবান, আল-কায়েদা এবং অপরাপর জঙ্গিগোষ্ঠী পাকিস্তানের ভূখন্ড ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান থেকে বিন লাদেনকে গ্রেফতার তারই প্রমাণ বহন করে। আফগানিস্তান থেকে বিশ বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবানরা আবারও ক্ষমতা দখল করেছে। এখন বাংলাদেশের সামনে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ঠেকানো। পুলিশ বলেছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জেহাদসহ উগ্রবাদী কেউ কেউ আফগানিস্তানে হিজরত করেছে, যাদের প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর আছে। বাংলাদেশে গোপনে জঙ্গিরা সক্রিয় থাকে। হলি আর্টিজানসহ অতীতের বেশকিছু বড় বিস্ফোরণের ঘটনা তার প্রমাণ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক কোন ঘটনার প্রভাবে এখানে যাতে বিচ্ছিন্ন কিছু না ঘটে, সেদিকে অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম গত মাসে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর এলাকার পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, তালেবানের আহ্বানে যুদ্ধ করার জন্য কিছু বাংলাদেশী আফগানিস্তান গেছেন। দেশ থেকে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অলরেডি কিছু মানুষ হিজরত করেছেন। আমরা ধারণা করছি, কিছু মানুষ ভারতে ধরা পড়েছেন। আর কিছু মানুষ হেঁটে বা অন্য উপায়ে আফগানিস্তানের পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। জঙ্গিদের নজরদারির জন্য সাইবার তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এখন সারা পৃথিবী সাইবার ওয়ার্ল্ডের মধ্যে বন্দী হয়ে গেছে। জঙ্গিরাও সাইবার মিডিয়াগুলো ব্যবহার করে তাদের রিক্রুটমেন্ট করার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে প্রবণতাগুলো দেখছি তা হলো, আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে, তালেবানদের পক্ষ থেকে। তিনি বলেন, শুধু আমরা নয়, সাইবার ওয়ার্ল্ডে বিভিন্ন সংস্থা তাদের মনিটর করার চেষ্টা করছে। যখনই সন্দেহভাজন কিছু পাওয়া যায়, আমাদের জানানো হয়। যত গোয়েন্দা সংস্থা আছে সবাই তৎপর আছে। যারা তালেবানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে যাচ্ছে তারা দেশেও ছোট ছোট ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে যাতে আর একটিও জঙ্গি হামলার ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। জঙ্গিদের প্রধান টার্গেট হলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা বলে মনে করেন ডিএমপি কমিশনার।