কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯০তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯৩০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতা হত্যাকারীদের নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে স্বামী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনিও শাহাদাত বরণ করেন।বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করবেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শহীদ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা ও পাঁচ বছর বয়সে মাতাকে হারান। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘রেনু’। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। দাদা শেখ কাসেম চাচাত ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেছার বিবাহ দেন। তখন থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মাতা সাহেরা খাতুন নিজের সন্তানদের সঙ্গে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে তিনি প্রাথমিক লেখাপড়া করেন। অতঃপর সামাজিক রীতিনীতির কারণে গ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন।
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের স্মৃতি শক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালী নারী ছিলেন তিনি। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যে কোন পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতেন। তার কোন বৈষয়িক চাহিদা ও মোহ ছিল না। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মানুষকে মুক্তহস্তে দান করতেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নেয়া ও পরিবার-পরিজনের যে কোন সঙ্কটে পাশে দাঁড়াতেন।
ইতিহাসে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব কেবল একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণীই নন, বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম এক নেপথ্য অনুপ্রেরণাদাত্রী ছিলেন। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন প্রাণপ্রিয় স্বামী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অবদান রেখেছেন। জীবনে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন, এ জন্য অনেক কষ্ট-দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে ছায়ার মতো অনুসরণ করে তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন বেগম মুজিব। বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু যখন বারে বারে পাকিস্তানী শাসকদের হাতে বন্দী জীবনযাপন করছিলেন, তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বঙ্গমাতার কাছে ছুটে আসতেন, তিনি তাদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা বুঝিয়ে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতেন। বিশেষ করে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিয়ে একটি কুচক্রীমহল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল, তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী : বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি এই মহীয়সী নারীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাঙালীর অহংকার, নারী সমাজের প্রেরণার উৎস। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা। যে কোন পরিস্থিতি তিনি বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা দিয়ে মোকাবেলা করতেন। তিনি কেবল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণীই ছিলেন না, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামেও তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রদূত। দেশ ও জাতির জন্য অপরিসীম ত্যাগ, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতা তাঁকে বঙ্গমাতায় অভিষিক্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীতে বলেন, জাতির পিতার রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সর্বক্ষণের সহযোগী ও অনুপ্রেরণাদায়ী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে ‘বঙ্গমাতা ত্যাগ ও সুন্দরের সাহসী প্রতীক’ প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে। যেখানে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতার কর্মময় জীবনের প্রকৃত অর্থ প্রতিফলিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর এবং বাঙালি মুক্তি সংগ্রামের সহযোদ্ধা। তিনি অসাধারণ বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, সর্বসংহা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তিনি আমৃত্যু দেশ ও জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সাফল্যেও বঙ্গমাতা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। দেশ ও জাতির জন্য তাঁর অপরিসীম ত্যাগ, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতার কারণে জাতি তাঁকে যথার্থই ‘বঙ্গমাতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। বঙ্গমাতার যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগে যুগে বাঙালী নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আমি আশা করি, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব- এর জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
কর্মসূচী : বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জন্মবার্ষিকী জাতীয়ভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গমাতা ত্যাগ ও সুন্দরের সাহসী প্রতীক’। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করবেন। এতে সভাপতিত্ব করবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা।
বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকীতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের আর্থিক সাহায্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দুস্থ নারীদের সেলাই মেশিন ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত সুবিধাভোগীদের তালিকা অনুযায়ী ৬৪ জেলায় তিন হাজার দুই শ’ সেলাই মেশিন ও তের শ’ দুস্থ ও অসহায় নারীদের মধ্যে দুই হাজার টাকা করে মোট ২৬ লাখ টাকা প্রদান করা হবে। একই সঙ্গে গোপালগঞ্জ জেলার দারিদ্র্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক শ’ ল্যাপটপ বিতরণ করা হবে।
সারাদেশে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতর সংস্থা বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকী উদযাপনে আলোচনা সভার আয়োজন করবে। এছাড়া মহীয়সী নারী বঙ্গমাতার গৌরবময় কর্মজীবনের উপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে।
এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শহীদ ফজিলাতুন্নেছার সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ শেষে কোরানখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। আওয়ামী লীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণসহ সহযোগী সংগঠনগুলো এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করবে। এছাড়া যুব মহিলা লীগ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে মোমবাতি প্রজ্বলনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে শনিবার দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বাংলাদেশ কৃষক লীগ আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।