নৈতিকতার অবক্ষয়

315

ফকীহুল ইসলাম নওরোজ

নৈতিকতার গুরুত্ব শূন্যের কোঠায়। প্রাচুর্য বিত্ত-বৈভবের মাঝে চিত্তের লালন-পালন প্রায় নেই বললেই চলে। আধিপত্য বিস্তারকারী প্রজাতি হিসেবে আমরা যখন বিশ্ব, বিত্ত ও অবস্থান করতলগত করার ঐকান্তিক অভিপ্রায়ে লিপ্ত, তখন আমাদের বিত্ত ভৃত্য সেজে গোলামী করছে নীতিহীনতার; অন্যায় অবিচারের ধারক-বাহক হিসেবে বিপথে চালিত করছে আমাদেরকে। আকাশছোঁয়া জ্ঞান ও বিত্তের পাহাড় একদিকে আমাদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করছে, অনদিকে ক্ষয়িষ্ণু নৈতিকতা আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে মানবজীবনকে নিম্নগামী করছে। ফলে এক বিপন্নতার মুখোমুখি আমরা, চরম অবক্ষয়ের সম্মুখীন আমাদের নৈতিকতা। সারবস্তুহীন আধুনিকতার খোলস আমাদের কাঁধে চেপেছে আরব্য রজনীর দৈত্য হয়ে, বিদেশী অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের মধ্যে গা ভাসাচ্ছি আমরা নির্দ্বিধায়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আমাদের কাছে মনে হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়। নৈতিক অবক্ষয় তাই বেড়ে চলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। সমাজের বুকে নেমে এসেছে নৈরাজ্য, অশান্তি আর হতাশা। স্বর্গীয় শান্তির পরিবর্তে নেমে এসেছে নরক যন্ত্রণা, সৃষ্টি হয়েছে অসহনীয় পরিবেশ। নৈতিকতার অবক্ষয়ই এর মূল কারণ।
আমাদের মাতৃভূমি কথা পুরো পৃথিবীতে বিরাজমান অনাচার, অবিচার, নৈরাজ্য, অশান্তি, খুন, রাহাজানি, শোষণ, নিষ্পেষণ চরম আকার ধারন করেছে। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে মানুষ আজ যে কোন কাজ নির্দ্বিধায় করতে পারে। বোধের নেই স্বচ্ছতা, লাগাম নেই সিদ্ধান্তের, নেই কোন বিবেকের তাড়না বা দংশন। আলো-অন্ধকার, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, সুন্দর কুৎসিত সবই এক। অবক্ষয়গ্রস্ত মানুষের সমাজের কল্যাণমূলক নেই কোনো ভাবনা। নেই কোন প্রচেষ্টা। ফলে সমাজের বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে এরা নানা অনিষ্ট আর অমঙ্গলের ধারক বাহক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এরা সমাজ ও জাতিকে নিক্ষেপ করে নৈরাজ্য ও অন্ধকারের অতলে। এই নারকীয় অবস্থা থেকে রেহাই পাবার জন্য নৈতিকতা ভুলে গেলে চলবে না।
আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় আজ লেগেছে ক্ষয়। বনাঞ্চলের ক্ষতির সাথে সাথে মনের অঞ্চলের ক্ষতি একেবারে কম নয়। চারদিকে ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে শুরু করে বৃহৎ গন্ডি, ঘরের দরজা থেকে বৃহত্তর সমাজ, পারিবারিক পরিবেশ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়- সবখানে শুধু নৈতিকতার অধঃগতি। এ অধঃগতির শিকার সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ছোট থেকে বড়, নবীন থেকে প্রবীণ কেউ বাদ পড়ছে না। নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্য আমাদের পারিপার্শি¦কতা প্রধানভাবে দায়ী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের শিক্ষার হার আশানুরূপভাবে বাড়লেও নৈতিকতার উন্নতি হয়নি বরং নৈতিকতার অবক্ষয় প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এ অবক্ষয় ও অবনতি-অশিক্ষা ও কুশিক্ষার ফল। অশিক্ষা বর্তমানে মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। আলোকিত পথ তাই অশিক্ষিত মানুষের নিকট রুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ক্যাম্পাস বোমা তৈরীর কারখানা। ছাত্র-শিক্ষক আজ অনৈতিক পথ বেছে নেয়াও তার জন্য খুবই সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। কুশিক্ষার প্রশিক্ষণ সমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার পাঠ্যক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষক প্রায়শই কুশিক্ষার পথ প্রশস্ত করছে দিন দিন। কাগজ কলমে শিক্ষিত হলেও অনৈতিক কার্যকলাপ কমছে না। বরং সমাজের উচ্চ শ্রেণী তথা উচ্চ শিক্ষিতরাই আজ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত।
২০১৫ এসেও আমাদের দেশ দারিদ্রের করালগ্রাস থেকে মুক্ত হয়নি। বরং এখনো এই স্বাধীন দেশের  ৩৩.৭% লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ এইসব লোক জীবন ও জীবিকার তাগিদে দিশেহারা হয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছে। দায়ী কে-? বেঁচে থাকার জন্য জগতপ্রবাহের সাথে সমগতিতে চলার জন্য অনৈতিক ও অপকর্মের সহযোগী হয়ে দাঁড়াচ্ছে অগণিত আদর্শ সন্তান।
আজ দেশে শিক্ষিত অশিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরীত ও বঞ্চিত। সর্বত্র হাহাকার আর আক্ষেপের দৃশ্য। বেকারত্বের এই চরম অভিশাপ তাদের কাজে না লাগিয়ে সর্বনাশার মতো অনৈতিক কাজে অংশ নেয়। তারা আজ তাদের জীবন ও কর্ম নিয়ে হতাশ। তাদের এই চরম দুঃসময়কে অতিক্রম করার জন্য দায়ী কে?
অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা খোলসযুক্ত অভিজাত্য ও আজন্ম লালিত কুসংস্কার মানুষকে অনৈতিক ও অমানবিক কাজের দিকে ঠেলে দেয়। অভিজাত্যের মিথ্যা অহংকার, সমাজের বুকে চেপে বসার উদ্ভট মানসিকতা মানুষকে নৈতিক বিষয়ে অন্ধ ও অজ্ঞ করে ফেলে। এ চিত্র দেখা যায় বিশেষত গ্রাম্য মাতব্বর ও মোড়লদের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ শুধু গ্রামাঞ্চল নয় শহরের বিভিন্ন অফিস কার্যালয়ে চাটুকার ও বিবেকহীন কর্মকর্তা এসব অশান্তির মূল কারণ। অভিজাত্য ও কুসংস্কার অনেকাংশ দায়ী। আর এসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের কোন স্বচ্ছ বিবেচনা নেই। নিজস্ব বিবেক ও বুদ্ধিপ্রসূত কোন মতামত ও সিদ্ধান্ত নেই বলে নৈতিক প্রশ্নেও তারা অন্ধ। কুশিক্ষাই এজন্য দায়ী। সুশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি কোন পরিস্থিতিতে কোন অনৈতিক চিন্তা ও কাজে নিজেকে জড়াতে পারে না, এমনকি সমর্থনও দিতে পারেনা।
নৈতিক অবক্ষয় রোধে দেশের সকলের সর্বাত্মক চেষ্টা ও সমর্থন প্রয়োজন। আদর্শ দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। নৈতিকতার উন্নতি এবং তার পরিচর্যা ও অনুশীলনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি প্রয়োজন। তা করার এখনই সময়। এ অবক্ষয় রোধ সকলের একান্ত দায়িত্ব। এ কর্তব্যে অবজ্ঞা বা অবহেলা করলে চরম দুর্ভোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
লেখক : কলামিস্ট।