কেন্দ্রীয় কারাগারে সেভেন মার্ডার মামলার আসামি নূর

50

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারত থেকে হস্তান্তরের ১৫ ঘণ্টা পর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি nur hosen_90621নূর হোসেনকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের আদালত। পরে তাকে বিকাল সোয়া চারটার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়।
গতকাল শুক্রবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে এসে দুপুরে আড়াইটায় আদালতে হাজির করা হয়। অল্প সময়ের শুনানি শেষে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সহিদুল ইসলাম তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তবে পুলিশ নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের কোনো আবেদন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত নজরুল ইসলামের পরিবার ও স্বজনরা।
এদিকে নূর হোসেনের ফাঁসির দাবিতে আদালতপাড়ায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন নিহত কাউন্সিলল নজরুলের স্বজন ও সমর্থকরা। পরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে নেয়ার আধঘণ্টা পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে যশোরের বেনাপোল পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে ভারত নূর হোসেনকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। এর পর তাকে র‌্যাব ও পুলিশ প্রহরায় প্রথমে উত্তরা র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে সকাল পৌনে ৭টার দিকে নেয়া হয়। সেখানে র‌্যাবের মিডিয়া উইং মুফতি মাহমুদ খান গণমাধ্যমকর্মীদের ব্রিফ্রিং শেষে নূর হোসেনকে নিয়ে সকাল সোয়া ৮টার দিকে র‌্যাব ও পুলিশের প্রহরায় নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারে নিয়ে রাখা হয়। এর আগে আদালতপাড়ায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এদিকে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আসার খবরে ভোর থেকে আদালতপাড়ায় ইলেকট্রনিক্স, প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় কর্মকরত গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় জমান। সকাল ১০টার দিকে নূর হোসেনকে আদালতে তোলার কথা থাকলেও পরে তাকে তোলা হয়নি। দুপুর আড়াইটার দিকে শহরের মাসদাইর পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মাথায় হেলমেট পরিয়ে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির করা হয়। এসময় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান, নজরুলের ভাই আব্দুল সালাম ও নিহত লিটনের বাবা হায়দার আলীসহ ৩০ থেকে ৩৫ জন লোক “নূর হোসেনের ফাঁসি চাই” বলে শ্লোগান দিতে থাকেন। একই সময় তারা “অভিযোগপত্র থেকে এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে বাদ কেন, প্রশাসন জবাব চাই” বলেও শ্লোগান দিতে থাকেন।
আদালতের কাঠগড়ায় তোলার সঙ্গে সঙ্গেই নূর হোসেন তার মাথা থেকে হেলমেটটি খুলে ফেলেন। এসময় তাকে কাঠগড়ায় স্বাভাবিক দেখা যায়।
আদালতে নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক মো. হাবিবুর রহমান জানান, নূর হোসেন সাত খুন মামলার অন্যতম আসামিসহ ১১টি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি। তাই তাকে সবগুলো মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে জেলহাজতে প্রেরণের আবেদন জানান।
এ সময় একটি মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটির পক্ষে তার আইনজীবী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নূর হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া নতুন কোনো মামলা রয়েছে কিনা? যেই মামলায় তাকে রিমান্ডে নেয়া যেতে পারে। পরে আদালত জানায়, নতুন কোনো মামলা নয়, ১১টি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।
এর আগে সকাল ১০টার দিকে আদালতপাড়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে এসে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, নূর হোসেনের বিরুদ্ধে খুনসহ ১৩টি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে ওই মামলায় তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে করার সুযোগ নেই।
অভিযোগপত্র থেকে এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে বাদ দেয়ায় বাদীর আপত্তির বিষয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা দীর্ঘ এক বছর তদন্ত শেষে আদালতে নির্ভুল অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। এছাড়া আদালতে দেয়া আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানন্দিতেও বাদ দেয়া এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামির সম্পর্কে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি বাদীও কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে পারেনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে। এই কারণে দুটি আদালতেই মামলার বাদীর না রাজি আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি নূর হোসেনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে না নিয়ে জেলহাজতে পাঠানোর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, আমি নারায়ণগঞ্জে কোর্টে বিচার পাইনি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। আমরা এখনও না-রাজির রিভিউ পিটিশন খারিজের কপি পাইনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গেই তার সহযোগীরা এলাকায় ফিরতে আসতে শুরু করেছে। তারা আমাদেরকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। আমাদের লোকজনদেরকে মারধর করছে। আমরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সিদ্ধিরগঞ্জে নূর হোসেনের সমস্ত কাজকর্ম আগের মতোই চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। নূর হোসেনকে অভিযোগপত্র দাখিলের আগে আনলে ভালো হতো। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অসম্পন্ন একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। আমরা নূর হোসেনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত? কারা পরিকল্পনাকারী, কারা অর্থের যোগানদাতা? র‌্যাব কেন আমার স্বামীকেসহ সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করবে? তাদের সাথে তো র‌্যাবের কোনো বিরোধ ছিল না। র‌্যাব চাইলে আমার স্বামীকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলতে পারতো, কিন্তু তা তারা করেনি। এই হত্যাকাণ্ডে র‌্যাবকে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার স্বামী যদি খারাপ লোক হতো, তাহলে তার জানাজায় লাখ লাখ লোক হতো না। তাই আমরা চাই, নূর হোসেনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং নতুন করে তদন্তের মাধ্যমে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হোক।
অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কেএম ফজলুর রহমান জানান, নূর হোসেনকে দুপুরে নারায়ণগঞ্জ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সহিদুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হলে ১১টি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাকে জেলহাজতে প্রেরণা করা হয়েছে। নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের মামলায় তার এক বছরের সাজা হয়েছে। এই মামলায় তাকে রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ নেই।
নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, সাত খুনের মামলার অভিযোগপত্র থেকে যেসব আসামি বাদ দেয়া হয়েছে, তাদের এবং নূর হোসেনের সহযোগীদের অত্যাচারে আমরা ঘর থেকে বের হতে পারছি না। প্রতিনিয়ত আমাদের অত্যাচার ও হয়রানি করছে।
তিনি বলেন, নূর হোসেনকে কে বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে? কার সাথে মুঠোফোনে কথা হয়েছে? এগুলো তদন্ত করলে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আর কারা কারা জড়িত তা বেরিয়ে আসবে। আমরা চাই নূর হোসেনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আড়ালে থাকা খুনিরা বেরিয়ে আসবে।
সাত খুনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের বাবা আব্দুল ওহাব। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাবো না। কিন্তু আমি আমার ছেলেসহ ইব্রাহিমসহ সাতজনকে খুনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। আমি চাই, যারা খুন করেছে আমার ছেলেকে, নূর হোসেন তাদের নাম বলে দিক।
সাত খুনের ঘটনায় একটি মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অভিযোগপত্র থেকে এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে বাদ দেয়া নারাজি রিভিশন মামলাটি আদালত খারিজ করেছে। আমরা এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে যাবো।
নূর হোসেনকে সাত খুনের মামলাসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া ১৩ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ নেই পুলিশের এমন দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে।