বন্যায় লাখো মানুষ পানিবন্দী

21

স্টাফ রিপোর্টার

ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটের অন্ততঃ ৮টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এসব উপজেলায় হু হু করে বাড়তে শুরু করছে পানি। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েন লাখো মানুষ।
খবর পাওয়া গেছে, অনেকের ঘরে গলা পর্যন্ত পানি ঢুকে পড়ে। এছাড়া অনেকের ঘর-বাড়ি তলিয়ে যায়। ভেসে যায় মুরগীর খামার, গবাদি পশু ও পুকুরের খামারের মাছ। এ অবস্থায় দিশেহারা ও আতঙ্কিত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে খুঁজে ছুটছেন বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষজন। বন্যায় সিলেটের কয়েকটি সড়কের যোগাযোগও বিছিন্ন রয়েছে।
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় নানা প্রস্তুতি নিয়েছে সিলেটের জেলা প্রশাসন। সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ- এই ৫টি উপজেলায় মোট ২১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৫৬, জৈন্তাপুরে ৪৮, কানাইঘাটে ১৮, কোম্পানীগঞ্জে ৩৫ ও জকিগঞ্জে ৫৮টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে মানুষজন উঠতে শুরু করেছেন। এছাড়া বন্যাকবলিত লোকজনের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ২০০ বস্তা করে মোট ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ১৫ মেট্রিক টন করে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, ৫০ হাজার টাকা করে আড়াই লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।
এদিকে, বুধবার সকাল থেকে এসব পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী। প্রয়োজন হলেই তারা তৎপরতা শুরু করবে বলে জানিয়েছেন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন।
জৈন্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা মো. সাজ্জাদুর রহমান সাজন। বুধবার রাতে পানি যখন বাড়ছিলো- উপায় না দেখে তিনি তার মা ও ছোট ভাইকে ফ্রিজের উপর তুলে দিয়ে নিজে চৌকির উপর দাঁড়ান। পানি যখন তার নাক বরাবর চলে আসে তখন বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। সাহায্য চেয়ে আগে অনেকগুলো পোস্ট দেন ভার্চুয়াল মাধ্যম ফেসবুকে। তার শেষ পোস্টটি ছিলো- লাশ উদ্ধার অইমু (হব) হয়তো, জীবিত উদ্ধার অইতে (হতে) পারতাম না…হয়তো এইটা শেষ পোস্ট। তবে তার পরিবারের সঙ্গে ঘটেনি কোনো অনাকঙ্খিত ঘটনা। মধ্যরাতে তাদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন স্থানীয় কিছু লোক।
বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি হু হু করে বাড়ছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সময় সময় জকিগঞ্জের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুপুর দুইটা পর্যন্ত বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীর পানি।
জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসনিম জানান, ইতোমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে প্রধান করে উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় মোট ৫৫ টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। তবে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ২২ টি পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।
জৈন্তাপুর সংবাদদাতা মোরাদ হাসান জানান, আকস্মিক বন্যায় আটকা পড়া মানুষদের উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, জৈন্তাপুর মডেল থানা পুলিশ টিম, ফায়ার সার্ভিস, আনসার বিডিপি এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। বৃহস্পতিবার সকালে পানি বন্দী এলাকাগুলো পরিদর্শন করছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজা আক্তার শীমুল। এসময়ে উপস্থিত ছিলেন, জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদ নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া সহকারী কমিশনার ভুমি ফাতেমা তুজ জোহরা সানিয়া, জৈন্তাপুর মডেল থানা পুলিশ অফিসার ইনচার্জ তাজুল ইসলাম পিপিএম।
কানাইঘাট সংবাদদাতা নিজাম উদ্দিন জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কানাইঘাট উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুরমা ও লোভা নদীর তীব্র স্রোতের কারণে বিভিন্ন এলাকায় সুরমা ডাইক ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করার কারনে উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব, লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম, দিঘীরপাড় পূর্ব, বড়চতুল, সদর ইউনিয়ন ও পৌরসভার সমস্ত জনপদ, জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রাস্তা-ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শত শত বাড়ি-ঘর হাটুপানি থেকে কোমর পানি বিরাজ করছে। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে কানাইঘাট সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ১৬৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকেল ৩টার দিকে তা কমে ১৪৩ সেন্টিমিটারে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি ডাইকের উপর দিয়ে ও ভাঙন দিয়ে প্রবেশ করায় গোটা উপজেলা ভয়াবহ আকার রূপধারণ করেছে। বুধবার রাত ৯টার পর থেকে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় গভীর রাতে ডালাইচর, গৌরিপুর, কুওরঘড়ি, উত্তর লক্ষীপ্রসাদ, দক্ষিণ লক্ষীপ্রসাদ, বোভারহাওর সুরমা ভাইকের বিভিন্ন স্থানসহ কানাইঘাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সুরমা ডাইকে বড় ভাঙনসহ নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা ভেঙে পানি দ্রæত লোকালয়ে প্রবেশ শুরু করে। গভীর রাতে পানিবন্দী হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদে বাড়ি-ঘর থেকে সরিয়ে আনার জন্য মসজিদে মসজিদে মাইকিং করা হয়। অপরদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য মনিটরিং সেল খুলে মানুষজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানের জন্য প্রচার করা হয়।
সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরিন বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ও ডাইক ভেঙে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ জুন কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হবে কি না এ নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন প্রার্থীরা।
গোয়াইনঘাট সংবাদদাতা কে.এম লিমন জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নেই বন্যার পানি বেড়ে চলেছে। উপজেলার সবক’টি ইউনিয়নের চতুর্দিকে পানিতে থই থই করছে। অনেকের ঘরের ভিতরে কোমর পানি। রাস্তাঘাটে পানি উঠে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কোথাও বের হতে পারছেন না মানুষ, নষ্ট হচ্ছে মালামাল। অনেকে ঘরের মালামাল রেখে আশ্রয়কেন্দ্রেও আসছেন না। ঘরে রান্নাবান্না নেই। নেই শুকনো খাবারও। মানুষের বাড়িঘরে দ্রæত পানি ডুকে পড়ায় অনেক মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, উপজেলার ৭০ ভাগের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ২৩৫৬ জন আশ্রয় নিয়েছে। গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে ৬৪৫টি। বন্যা দুর্গত বিপুল সংখ্যক জনগণ নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজনের নিরাপদ উঁচু স্থাপনাতেও আশ্রয় নিয়েছেন। উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের পানি সারি-পিয়াইন ও ডাউকি নদী দিয়ে এলাকায় দ্রæত গতিতে বাড়ছে। এতে উপজেলার পূর্ব জাফলং, মধ্য জাফলং, পশ্চিম জাফলং, পূর্ব ও পশ্চিম আলীরগাঁও, রুস্তমপুর, বিছনাকান্দি, লেঙ্গুড়া, ডৌবাড়ি, ফতেহপুর, তোয়াকুল, নন্দীরগাঁও এবং সদর ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। উপজেলা সদরের সাথে সবক’টি ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ার ফলে অনেকে ভোগান্তিতে পড়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বন্যা খুব ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। এমন বন্যা গত দুই যুগেও দেখেননি তারা। বাড়িঘরে পানি উঠে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তারা।