কাজির বাজার ডেস্ক
বাংলাদেশে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। কয়েক বছর ধরেই এমন প্রাণহানি বাড়তে থাকায় জনমনে উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার দেশের পাঁচ জেলায় বজ্রপাতে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, নেত্রকোনা, যশোর ও পিরোজপুরে এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে ২ দিনে বজ্রপাতে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই বছরই বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখনই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয় বৃষ্টি হবে, তখনই বজ্রপাত হবে বলে ধরে নিতে হবে। বিশেষ করে এপ্রিল, মে ও জুনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এমন আবহাওয়া থাকে। তবে মার্চ থেকেই শুরু হয় বজ্রপাতের অনুক‚ল পরিবেশ।
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, বিশ্বে যতসংখ্যক মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। দেশের হাওর-বাঁওড় ও বিলপ্রবণ জেলায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়, এর মধ্যে ৭০ শতাংশই মাঠে থাকা কৃষক। এছাড়া সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময় বজ্রপাতের কবলে পড়েন।
ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইয়ারলি এভারেজ লাইটেনিং ডেনসিটি ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক প্রতি বর্গকিলোমিটারে বজ্রপাতের প্রবণতার হার ১৫ দশমিক ৪৫। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি জেলায় কমবেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। তবে শহরের তুলানায় গ্রামাঞ্চলে এবং হাওর এলাকায় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ১০ জেলায় বজ্রপাতের ঘটনা এবং মৃত্যু বেশি হয়। জেলাগুলো হলো- সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাড়ছে মূলত সতর্কতা না থাকার কারণেই। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ রোধে মানুষের কোনো হাত নেই। তবে বজ্রপাতনিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। শহরে বেশির ভাগ ভবনে বজ্রনিরোধক দÐ থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু তেমন হয় না। কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে গিয়ে খোলা মাঠের কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার কারণে বজ্রপাতের প্রবণতা বাড়ে। প্রথমত, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বায়ুমÐলের আদ্রতা বেড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, হিমালয়ের পাদদেশে হাওরাঞ্চলগুলোতে উষ্ণতা ও পুঞ্জিভ‚ত মেঘের আধিক্য। তৃতীয়ত, কিউমুলোনিম্বাস মেঘ বা ঝড়োপুঞ্জ মেঘ এবং চতুর্থত, পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, ১ ডিগ্রি উষ্ণতা বাড়লে বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়ে যায় ১০ থেকে ১২ বর্গকিলোমিটার। সামাজিক সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম
অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএএফ) সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এপ্রিল থেকে জুন এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া এবং গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ কেটে ফেলা বা না থাকার কারণে বজ্রপাত বেড়ে গেছে। একটা সময় দেশে প্রচুরসংখ্যক বড় বড় গাছ ছিল। যেমন তাল, সুপারি, নারকেল। আর এখন মাঠের পর মাঠে কোনো বড় গাছ দেখা যায় না। আমরা গাছ কেটে ফেলেছি। হাওরাঞ্চলের বিশাল ভ‚মিতে বজ্রপাতের সময় কৃষকরা আশ্রয় নেয়ার কোনো জায়গা পায় না। আবার জায়গা থাকলেও সেখানে বজ্রনিরোধক থাকে না। ফলে, সেখানে মৃত্যু বেশি। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে দ্রæত বর্ধনশীল গাছ লাগানো, মাল্টিপারপাস শেল্টার সেন্টার তৈরি, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে কৃষকদের মাঠে কাজ করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।
জানা যায়, বজ্রপাত প্রতিরোধ ও মানুষের জীবন বাঁচাতে সারাদেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি তাল গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সারাদেশে ৩৮ লাখ চারা রোপণের পর তা এক বছরের মধ্যেই অযতœ অবহেলায় মারা যায়। এছাড়া তালগাছ বড় হতে সময় বেশি লাগার কারণে সরকার এ পরিকল্পনা বাতিল করে। এর পরিবর্তে ১ হাজার ৩শ কোটি টাকা ব্যয়ে লাইটিনিং অ্যারেস্টারসহ লাইটিনিং শেল্টার নির্মাণ এবং আর্লি ওয়ার্নিং ফর লাইটিনিং, সাইক্লোন অ্যান্ড ফ্লড- এই দুটি প্রকল্প নেয়। এছাড়া বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় লাইটিনিং অ্যারেস্টার স্থাপন করা হয়।