কাজির বাজার ডেস্ক
অল্প বেতনের সরকারি চাকরিও যেখানে ইতোমধ্যেই ‘সোনার হরিণ’ হয়ে গেছে, সেখানে শুধুমাত্র সরকারি চাকরির আশায় অধিকাংশ তরুণই এখন আর বসে থাকেন না। কিন্তু বেসরকারি খাতের যে সম্ভাবনা ছিল তারও এখন নাজুক অবস্থা। আর বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় সদ্য স্নাতকদের জন্য কেবল চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেয়াটাও যেন একটি বিলাসিতা। এদিকে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো চলতি বছরের আগস্টে সরকারি চাকরির আবেদনের ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোতে চাকরির আবেদনকারীদের জন্য সামগ্রিক খরচ বৃদ্ধি পাবে। সদ্য-স্নাতকদের জন্য বেসরকারি খাতেও চাকরির বর্তমান পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করা মামুনুর রশীদ সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সুযোগ পেলেও এখন তাকে চানখারপুল এলাকায় একটি মেসে আশ্রয় নিতে হয়েছে। নতুন জীবনে মেসভাড়া, খাবার, বই ও স্টেশনারি ইত্যাদি কিনতে তার অনেক টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। মামুনুর টিউশন করেন বটে কিন্তু মাস শেষে তার টান পড়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি এবং মূল্যবৃদ্ধির ঢেউ আমাদের মতো বেকারদের জন্য ঢাকায় টিকে থাকার সম্ভাবনাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমাকে এখন প্রতিমাসে বন্ধুদের কাছ থেকে কমপক্ষে দুই-তিন হাজার টাকা ধার করে চলেত হচ্ছে।’ দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অভ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এর যৌথভাবে পরিচালিত ‘দ্য স্টেট অভ বাংলাদেশ’স পলিটিক্যাল গভর্নেন্স, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি’ শীর্ষক একটি সমীক্ষার সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের অর্থনীতি ভুল পথে এগোচ্ছে বলে অনেকের বিশ্বাসের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের অভাব।
সমীক্ষা অনুসারে, ২০২২ সালে ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ভুল দিকে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ প্রধান কারণ হিসাবে পণ্যের উচ্চমূল্যকে দায়ী করেছেন। অন্যরা কর্মসংস্থানের অভাব (১৬%), কাজের চাপের তুলনায় কম বেতন (১০%) এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবকে (৮%) কারণ হিসেবে মনে করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বাংলাদেশে মাত্র ২৫ লাখ বেকার ছিল। তবে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যান্য সংস্থার অনুমান অবশ্য পরিস্থিতির কঠিন রূপকেই তুলে ধরেছে। এ বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৩৫ লাখ লোক বেকার থাকবে, যা মহামারীর আগের সময়ের তুলনায় চার লাখ বেশি বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর ২২ লাখের বেশি যুবক চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।
তবে আরও হতাশাজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)-এ যোগদানের ক্ষেত্রে জট তৈরি হয়েছে। ফলে আরও আশাহত হচ্ছেন সদ্য-স্নাতকরা। সার্কুলার পাওয়া থেকে শুরু করে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা অংশ নেয়া এবং ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি হওয়া পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর একটি বিসিএস পরীক্ষাচক্র শেষ করতে কমপক্ষে তিন বছর লাগে। চলতি বছরের আগস্টের শুরুতে ৪১তম বিসিএসের চ‚ড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছে। তবে পিএসসি এখনও আরও তিনটি বিসিএস পরীক্ষাÑ ৪৩তম, ৪৪তম ও ৪৫তম নিয়ে কাজ করছে। বিসিএস-এ এই জট ও একাধিক পরীক্ষার প্রক্রিয়া একই সময়ে চলার কারণে এটি প্রার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। তবে বিপরীতক্রমে, করোনা ভাইরাস মহামারীর পর থেকে সরকারি চাকরিতে শূন্যপদের সংখ্যা পাঁচ লাখে পৌঁছেছে। এসব পদ পূরণে সরকারের ধীরগতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
খুলনা থেকে সম্প্রতি স্নাতক শেষ করা প্রসেনজিৎ দাস বলেন, ‘গত সপ্তাহে খাদ্য অধিদপ্তরে একটি চাকরির বিজ্ঞপ্তি পেয়েছি। এর আগে আমি গত দুই-তিন বছরে এমন কোনো চাকরির সুযোগ পাইনি যেখানে আমি চাকরির সবগুলো শর্ত পূরণ করতে পেরেছি।’ বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় সদ্য স্নাতকদের জন্য কেবল চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেয়াটা একটি বিলাসিতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন স্নাতক হওয়া ফাতেমা ইসলামের পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যে, এখন পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়ও তাকে একটি পূর্ণকালীন চাকরি চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ‘পড়ালেখার সময় পরিবার সবসময় আমার খরচ জোগাত। কিন্তু ২৫ বছর বয়সে এসে আমি কীভাবে তাদের কাছ থেকে টাকা নেব? বরং তারা প্রতিমাসে আমার কাছ থেকে কিছু টাকা আশা করে। এছাড়া আমি শুনেছি যে বিসিএস ভাইভাতে অনেক প্রার্থীকে পূর্ণকালীন চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ভর্ৎসনা করা হয়।’
এদিকে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো চলতি বছরের আগস্টে সরকারি চাকরির আবেদনের ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোতে চাকরির আবেদনকারীদের জন্য সামগ্রিক খরচ বৃদ্ধি পাবে।
ভ্যাট প্রাথমিকভাবে সার্ভিস চার্জের (টেলিটক বাংলাদেশের কমিশন) ওপর ধার্য করা হবে, যা পরীক্ষার ফি-এর ১৫ শতাংশ। দুটি বিজ্ঞপ্তির তুলনা করে দেখা গেছে, শুল্ক বাড়ানো হয়নি, শুধু ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। নবম-গ্রেড পদের জন্য একজন আবেদনকারী ব্যক্তির আবেদন ফি ৬০০ টাকা। এটি টেলিকম বাংলাদেশ সার্ভিস চার্জ ১০ শতাংশ (৬০ টাকা) এবং এই সার্ভিস চার্জের ওপর ১৬ শতাংশ ভ্যাট (৯ টাকা) চার্জের মাধ্যমে বাড়বে। এতে নবম শ্রেণির চাকরি প্রার্থীদের তাদের আবেদনের জন্য ৬৬৯ টাকা দিতে হবে। সদ্য-স্নাতকদের জন্য বেসরকারি খাতেও চাকরির বর্তমান পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বিডিজবস-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা একেএম ফাহিম মাসরুরের মতে, ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতির কারণে আগের বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তাদের ওয়েবসাইটে চাকরির পোস্টিংয়ের সংখ্যা তেমন বাড়েনি। তিনি বলেন, ‘সম্প্রসারণের পরিবর্তে কারখানাগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা আশঙ্কা করছি, বেসরকারি খাতের চাকরির বিজ্ঞাপন আগামী তিনমাসে আরও নাজুক হয়ে উঠবে।’
জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি (নাসিব)-এর সভাপতি মির্জা নুরুল গনি শোভন বলেন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করছেন না, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আরও বাধা সৃষ্টি করছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ডিগ্রি নিয়ে সম্প্রতি পাশ করা তানজিম ইসলাম (ছদ্মনাম) জানান, তিনি দেশে কয়েকটি চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু বেতন অত্যধিক কম হওয়ায় তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভালো চাকরির প্রস্তাব না পেলে দেশে ফিরবেন না বলে জানান তানজিম। দেশের একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করা সোহরাব হোসেন মরিয়া হয়ে চাকরি খুঁজছেন। তার মতো স্নাতকদের জন্য বেসরকারি খাতে খুব কমই আকর্ষণীয় চাকরির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের স্নাতকদের মধ্যে কেবল কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের (সিএসই) শিক্ষার্থীরা কিছু সুবিধা পায়। অন্যান্য শাখার শিক্ষার্থীরা খুব বেশি সার্কুলার পায় না, কারণ বেশিরভাগ সংস্থাই বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট বা ডিপ্লোমা স্নাতকদের চায়। এমনকি চাকরি পেলেও শুরুর বেতন খুব কমই ২০ হাজার টাকা ছাড়ায়।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসে (বেসিস)-এর সভাপতি রাসেল টি আহমেদও একই কথাই বলেছেন। তার মতে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এখন মানসম্পন্ন স্নাতকের চাহিদার তুলনায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। শীর্ষস্থানীয় সংস্থাগুলোতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে শিক্ষানবিশ কর্মীদেরকেও আবশ্যিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামিং, অ্যালগরিদম এবং ডেটা স্ট্রাকচারে শক্তিশালী দক্ষতা রাখতে হয়। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য প্রারম্ভিক বেতন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়। প্রাথমিক তিন থেকে ছয় মাসে প্রশিক্ষণার্থীরা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মাসিক বেতন পেতে পারেন। স্থায়ী হওয়ার পরে এ বেতন কেবল ২৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ে। কিন্তু যারা গ্রামীণ এলাকা থেকে আসেন, তারা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। করোনা ভাইরাস মহামারীর সময় দেশে অনলাইন শিক্ষা এবং সুযোগের একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল বটে, কিন্তু দক্ষতা অর্জনের সুযোগের অভাবে গ্রামের বাসিন্দারা তাদের শহুরে প্রতিযোগীদের তুলনায় ভীষণ বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তবে পেশাগত দক্ষতা প্রশিক্ষক বায়েজিদ খান রাজীবের মতে, দেশের তরুণ স্নাতকদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতির শিকড় আরও গভীর ও স্থায়ী।
তার মতে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখায় ন্যূনতম ১৭ বছর ব্যয় করে চাকরিতে প্রবেশ করার সময় দেখতে পান, কর্মক্ষেত্রে দরকারি অনেক দক্ষতার সঙ্গেই তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জন করা জ্ঞান ও দক্ষতার মিল নেই। তিনি বলেন, ‘এ পার্থক্য তৈরি হয় কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্যক্রম বর্তমান শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ গেøাবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় ১০৫তম, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে ৮৭তম, উচ্চশিক্ষায় ১০৯তম, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে ৯৪তম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ১০৬তম, অর্থনীতিতে ৯২তম এবং পরিবেশ সক্ষমতায় ১১৯তম অবস্থানে রয়েছে। দক্ষতার অভাব ও পরবর্তীকালে চাকরি নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা দেশের সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে বলে বায়েজিদ মনে করেন। কেউ কেউ হতাশায় আত্মহত্যার দিকেও পা বাড়াচ্ছেন।
আঁচল ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করছেন। এক্ষেত্রে পারিবারিক কলহ, পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল না পাওয়া, আর্থিক সংকট, চাকরি না পাওয়া, প্রেমে ব্যর্থতার মতো কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিষণœতায় ভোগেন। এক পর্যায়ে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।’