কাজিরবাজার ডেস্ক :
দলীয় হাইকমান্ডের ব্যর্থতায় মাঠের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কোন চেষ্টাই করছে না দলটি। এ নিয়ে দলের ত্যাগী ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হাইকমান্ডের ওপর চরম ক্ষুব্ধ। তাই মাঝেমধ্যে নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় করা হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায় না। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় বিএনপি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এদিকে নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন দূরে থাক দলের রুটিন কর্মসূচীও ঠিকমতো পালন করতে পারছে না বিএনপি। আর যাও কিছু ছোটখাট কর্মসূচী পালন করা হয় তাতেও লোকসমাগম হয় না। দলের এ পরিস্থিতির জন্য তৃণমূল নেতারা সিনিয়র নেতাদের দায়ী করছেন। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি কেরানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে অনশন কর্মসূচী পালন করে কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে ব্যর্থতার অঙ্গুলি প্রদর্শন করে গেছে। এ বিষয়টি নিয়ে এখন দলের সর্বস্তরে আলোচনা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
গঠনতন্ত্র অনুসারে ৩ বছর পর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও দলীয় হাইকমান্ডের ব্যর্থতার কারণে ১৯ মার্চের মধ্যে তা করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য দলের তৃণমূল নেতারা চরম ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তকেও দলীয় হাইকমান্ডের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছে তৃণমূল নেতারা। আর দলীয় হাইকমান্ড তৃণমূল নেতাদের এমন মনোভাব জানতে পেরে যারা উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এমন প্রায় ২০০ জনকে ইতোমধ্যেই বহিষ্কার করেছে। তবে সিনিয়র নেতারা জেলা-উপজেলা সফরে গেলে বহিষ্কৃত নেতারা কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের এক বৈঠকে মাঠের রাজনীতি সক্রিয় করার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ সময় কয়েক সিনিয়র নেতা এ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন। কেউ কেউ বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দলীয় হাইকমান্ড দলকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পেরেছে কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। আর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নেতারাও কে কি করছেন তার হিসাবও মিলিয়ে দেখতে হবে।
সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব ত্যাগী নেতাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়েছে তারা এখন দলে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। কেন্দ্র থেকে বার বার তাগিদ দিয়েও তাদের দলমুখী করা যাচ্ছে না। কেউ কেউ দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। আর যারা মনোনয়ন পেয়েও শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছেন তারাও হতাশ। তাদের মতে, দলীয় হাইকমান্ডের ভুল কৌশলের কারণে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের ২০০ নেতাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এরা নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয় হওয়ায় তাদের সঙ্গে আরও অনেক নেতাকর্মী দলীয় কর্মকান্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপি নেতাদের যুক্তি হচ্ছে, তৃণমূল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে হলে নির্বাচন বর্জনের কোন সুযোগ নেই। বরং নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয় লাভ করতে না পারলেও দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় থাকে। কিন্তু বিষয়টি উপলব্ধি না করেই কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয় উপজেলা নির্বাচন না করতে। এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিএনপির কয়েক শ’ নেতাকর্মী এবার উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে। তবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তৃণমূল নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেয়ায় অধিকাংশই পরাজিত হলেও কেউ কেউ ইতোমধ্যেই নির্বাচিত হয়েছেন।
এক কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা জানান, বর্তমানে মাঠের রাজনীতিতে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই নিষ্ক্রিয়। তবে দলকে এগিয়ে নিতে সরাদেশের সর্বস্তরে নেতাকর্মীর মনোবল চাঙ্গা করে মাঠের রাজনীতি সক্রিয় করতে চান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ জন্য রাজধানীতে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি জেলায় জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলীয় হাইকমান্ড। ইতোমধ্যেই বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিভিন্ন জেলা নেতাদের এ কথা জানানো হয়েছে। আর জেলা নেতারাও নিজ নিজ এলাকায় কর্মসূচী পালন করতে চান। কিন্তু সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সাড়া না থাকায় বিশেষ করে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনের আড়াইমাস পরও জেলা-উপজেলা সফরে যেতে রাজি না হওয়ায় এ কর্মকান্ড হালে পানি পাচ্ছে না। এ কারণে তারেক রহমান নিজেও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের হতাশ নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে যত শীঘ্র সম্ভব জেলায় জেলায় কর্মসূচী পালন করতে নির্দেশ দেন লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কারাবন্দী দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া নেতাদের এমন নির্দেশই দেন। তবে তিনি কারাগারে থাকায় তার নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে পারেন না। এ সুযোগে দলের সিনিয়র নেতারাও বিষয়টিকে সেভাবে আমলে নেন না। আর সিনিয়র নেতারা গাছাড়া ভাব দেখিয়ে চলায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও সক্রিয় হতে চান না।
জানা যায়, সারাদেশে কর্মসূচী পালন করে মাঠের রাজনীতিতে দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার পাশাপাশি সর্বস্তরে দলের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের অনীহার কারণে থমকে আছে। এ কারণে নির্বাচনের পর দল গোছানোর কাজও থেমে গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমে বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে কয়েকটির পুনর্গঠন শুরু হলেও এখন আর হচ্ছে না। কথা ছিল অঙ্গ সংগঠনগুলো পুনর্গঠনের পর সারাদেশে জেলা-উপজেলা কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। এর পর সুবিধাজনক সময়ে দলের জাতীয় কাউন্সিল করা হবে। কিন্তু এখনও সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। সম্প্রতি বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দলের ৩ স্থায়ী কমিটির সদস্য চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজপথে ঘুরে দাঁড়াতে দ্রুত বিএনপির পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন দরকার বলে মন্তব্য করেন। তাদের এ বক্তব্যের পর পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হলেও কিছুদিন পরেই তা থেমে যায়। এর ফলে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের কথা থাকলেও এখন সে পথে যেতে সাহস পাচ্ছে না বিএনপি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি ছাড়াও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী দিতে না পারায় সারাদেশের সর্বস্তরের বিএনপি নেতাকর্মীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। আর হাঁকডাক দিয়েও রাজপথে কোন কর্মসূচী না থাকায় বিএনপির রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ কমে যায়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে দলবিমুখ হয়ে পড়ে। এ অবস্থার অবসানে নতুন উদ্যমে সর্বস্তরে দলকে চাঙ্গা করতে জনসংযোগ কর্মসূচীও শুরু করতে পারছে না বিএনপি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচীর কারণে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিশেষ করে পেট্রোলবোমার আঘাতে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা দেশের মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি। তাই আবারও আন্দোলন শুরু করলে বিএনপির প্রতি দেশ-বিদেশে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয় কিনা সে বিষয়টি মাথায় থাকায় বিএনপি এখন আন্দোলনও শুরু করতে পারছে না। কারণ, আন্দোলনের কথা মনে হলেই মানুষ এখন বিএনপির বিরুদ্ধে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের অভিযোগ উত্থাপন করে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই নেতিবাচক আন্দোলনের সমালোচনা হয়। আর এ কারণেই এর পর আর বিএনপি আন্দোলনে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছে না। সূত্র জানায়, নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় থাকায় নতুন কর্মসূচী দিতেও বার বার ভাবতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতাদের। তাই পরবর্তীতে যাতে অতীতের মতো রাজপথের কোন কর্মসূচী ব্যর্থ না হয় সে জন্যই ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাড়াহুড়া না করে ধীরলয়ে এগুতে চাচ্ছে তারা। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে ধাপে ধাপে কর্মসূচী পালন করে এগিয়ে যেতে চায় বিএনপি হাইকমান্ড। সম্প্রতি দলীয় এক ফোরামে এ বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। তবে দল পুনর্গঠন না করে এবং সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না করে বড় ধরনের কোন কর্মসূচী পালনের দিকে যেতে চাচ্ছে না দলটি। কবে নাগাদ দল পুনর্গঠন ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে দলীয় কর্মকা-ে সক্রিয় করা যাবে সে বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কারণে মাঠের রাজনীতিতে এখন অনেক নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয়। এখনই তাদের সক্রিয় করা যাচ্ছে না। তবে সর্বস্তরে দল পুনর্গঠন করে আবারও তাদের সক্রিয় করার চেষ্টা রয়েছে। বিএনপিকে এখন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে রাজনীতি করতে হচ্ছে। তাই ইচ্ছে করলেই যখন যা ইচ্ছে তা করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় তার নির্দেশনা নিয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপও নেয়া যাচ্ছে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিদেশে অবস্থান করছেন।