কাজির বাজার ডেস্ক
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়কে সমর্থন করে বৈঠক করেছেন ইউরোপীয় দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আইনসভা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের (ইপি) এমপিরা। গত ৩ জুলাই বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে হয়েছে এই বৈঠক। ব্রাসেলসভিত্তিক সাময়িকী হিউম্যান রাইটস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স ইন্টারন্যাশনাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গেøাবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্স এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের এমপি ফুলভিও মারটাসকিলোর যৌথ উদ্যোগে হওয়া এই বৈঠকে ইপি’র আইনপ্রণেতাদের (এমইপি) পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরাও।
বৈঠকে উপস্থিত এমইপি ইসাবেলা অ্যাডিনলফি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের নিরীহ বেসামরিকদের লক্ষ্য করে পাকিস্তান বাহিনী যে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন-নিপীড়ণ চালিয়েছে, তাকে ‘আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই ইউরোপীয় নেতা বলেন, ‘আমি মনে করি, অর্ধশতাব্দী আগে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশে যে গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, রক্তপাত ও সীমাহীন অত্যাচার করেছিলÑ ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত তাকে আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।’
বৈঠকে উপস্থিত গেøাবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্সের প্রেসিডেন্ট সারদানন্দ শীতল জানান, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম বড় আকারের এবং ভয়াবহ মাত্রার হত্যাযজ্ঞ। নাৎসী বাহিনীর নির্মমতাকে যে কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই একই কারণে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাÐও গণহত্যা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি রাখে। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হওয়া সত্তে¡ও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করছিল দেশটির তৎকালীন সামরিক নেতৃত্ব। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে কম আসন পেয়ে বিরোধী দল হওয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এই ইস্যুতে সামরিক নেতৃত্বকে সমর্থন করেছিল।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সামরিক নেতৃত্বের এই টানাপোড়েনের মধ্যেই ২৫ মার্চ ঢাকায় ‘অপরাশেন সার্চলাইট’ পরিচালনার নামে নিরীহ বেসামরিকদের ওপর কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক বাহিনী। পাক সেনারা ‘অপরেশন সার্চলাইট’ শুরুর পর ওই রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং পাক সেনারা তাকে গ্রেপ্তার করে।
তারপর ৯ মাসের এক ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। এই নয় মাসে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ লাখ নারী এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ।
ব্রাসেলসের বৈঠকে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয় সম্মেলনে। সেই তথ্যচিত্রে পাক বাহিনীর হত্যাকাÐের কারণে স্বজন হারানো কয়েক জনের সাক্ষাৎকার দেখানো হয়। অনেকেই ১৯৭১ সালের ভয়াবহ সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেন সেই তথ্যচিত্রে। ৩ জুলাইয়ের বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ক রাষ্ট্রদূত মাহবুব হাসান সালেহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে ’৭১ সালের হত্যাকাÐকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কাজ করছি। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের যেসব আইনপ্রণেতা এবং ইউরোপের যেসব মানবাধিকার সংস্থা আমাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা জানালেনÑ তাদের প্রতি বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। এ বিষয়ক একটি রেজোল্যুশন ইতোমধ্যে জাতিসংঘের কার্যতালিকায় নথিভুক্ত হয়েছে। আমরা আশা করছি, সেই রেজোল্যুশনের ওপর ভোটের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের পাশে থাকবে।’