বিটিটিসি এখনও রিপোর্ট তৈরি করতে পারেনি ॥ নয় পণ্যের দাম নির্ধারণে অনিশ্চয়তা

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভোক্তাস্বার্থ নিশ্চিত করতে নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণে চরম সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সময় বেঁধে দিলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি। পণ্যের দাম নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে কোন কমিটি না থাকায় এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবসম্মত কিনা তা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ নিয়ে কৃষি, খাদ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দাম নির্ধারণের বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে ‘একতরফা’ হিসেবে। চার মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানির পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকেও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখানো হচ্ছে না। ফলে খাতভিত্তিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছে না বিটিটিসি। ফলে নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। কবে নাগাদ দাম নির্ধারণ হবে সে বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে ভোক্তাদের। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
অভিযোগ রয়েছে, পণ্যমূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা লুফে নিতে দেশে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে প্রমাণিতÑ আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশে কয়েকগুণ বেশি দামে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে। পণ্যমূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করার বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত দুটি প্রতিবেদন পায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরই চাল, মসুর ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, চিনি, আটা, ময়দা, সিমেন্ট ও রডের দাম নির্ধারণ করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। যদিও ভোজ্যতেলের দাম আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনির দাম নির্ধারিত থাকলেও কার্যকর নেই বাজারে। এখন বেশি দামে ভোক্তাকে চিনি কিনতে হচ্ছে।
এদিকে, পণ্যমূল্য নির্ধারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিটিটিসিকে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে বিটিটিসি এখনও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে পারেনি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণের বিষয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যুগ্মসচিব আঃ নূরুল হক বলেন, নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণের বিষয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিটিটিসিকে দ্রুত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এখন তারা (বিটিটিসি) প্রতিবেদন উপস্থাপন করেনি। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পরই মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করে নয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে সক্ষম হবে। তিনি জানান, নয় পণ্যের উৎপাদন, বিপণন এবং শিল্প খাত বিকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও তিনটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। তবে দাম নির্ধারণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তাই বিটিটিসির প্রতিবেদনের আলোকে আপাতত দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, নয়টি পণ্য ধরে ধরে তথ্য চেয়ে আমদানিকারক ও উৎপাদকদের চিঠি দিচ্ছে ট্যারিফ কমিশন বা বিটিটিসি। ইতোমধ্যে চাল, মসুর ডাল, আটা, ময়দা, রড ও সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্য পাঠাতে তিনদিনের সময় বেঁধে দেয়া হলেও তাতে ব্যবসায়ীদের সাড়া মিলছে না। আটা, ময়দা, মসুর ডাল ও সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তথ্য দেয়া হলেও তা আংশিক এবং ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করছেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে ট্যারিফ কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, নয়টি পণ্য সংশ্লিষ্টদের কাছেই চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তথ্য-উপাত্ত পেলে তা বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, বিটিটিসি তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে। সেসব তথ্য পাওয়ার পর আমদানির ক্ষেত্রে কাঁচামালের দাম কতটা বেড়েছে তা বিশ্লেষণ করে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। সূত্রগুলো বলছে, চাল ও পেঁয়াজের মতো ভোগ্যপণ্য দুটি দেশে উৎপাদন হয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত। আবার ভোজ্যতেল ও ডাল আমদানিনির্ভর পণ্য।
এ দুটির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বেশি কাজ করে থাকে। একই সঙ্গে চাল, গম বা আটা বা ময়দা আমদানিসংশ্লিষ্ট পণ্য।
এ কারণে খাদ্য মন্ত্রণালয় এসব পণ্যের বিষয়ে কাজ করছে। চিনি, সিমেন্ট ও রডের বিষয়টি দেখছে শিল্প মন্ত্রণালয়। ফলে এ তিনটি পণ্যের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতামত জরুরী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। এ সংক্রান্ত কোন কমিটি গঠন করা হয়নি। এমনকি আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কোন মতামত বা সুপারিশ নেয়া হয়নি। এতে করে ইতোমধ্যে দু’একটি মন্ত্রণালয় অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দাম নির্ধারণের ঘোষণা দিলে ওইদিন বিকেলেই কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বক্তব্য রেখেছেন। বর্তমান সময়ে এটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে কৃষিমন্ত্রীর। শিল্প ও খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকেও এ ব্যাপারে তেমন সাড়া কিংবা আগ্রহ দেখানো হচ্ছে না। ফলে নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ নিয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এ ধরনের একটি ভাল উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয় কিনা; তা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ রয়েছে।ু
কারসাজি করে অতিমুনাফা করার বিষয়টি প্রমাণিত : কারসাজি করে নয়টি পণ্য থেকে অতিমুনাফা করার বিষয়টি প্রমাণিত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত এক মাসে বিশ্ববাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কতটুকু বেড়েছে এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে দেখা গেছে, এক মাসে বিশ্ববাজারে মসুর ডালের মূল্য বেড়েছে দশমিক ৭৮ শতাংশ। বিপরীতে দেশের বাজারে ডালের দাম বেড়েছে বড়দানা ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও ছোটদানা ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
দেশে মোট মসুর ডালের প্রায় ৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে আমদানি করা হচ্ছে ৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। বাকিটা উৎপাদন হচ্ছে দেশেই। এই আমদানি ঘিরেই সর্বক্ষেত্রে মূল্য কারসাজি করা হয়। এছাড়া চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে মাত্র ৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদন হয় ২৭ লাখ ৩০ হাজার টন। এই পেঁয়াজের মূল্য ঘিরেও কারসাজি হয়েছে এ বছর। পেঁয়াজের মূল্য একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে বেড়েছে আমদানিকৃত পেঁয়াজের মূল্য ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং দেশীয় পেঁয়াজ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। গত এক মাসে বিশ্ববাজারে চিনির মূল্য ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে। অথচ দেশের বাজারে এর প্রভাব নেই। চিনির দাম না কমে উল্টো বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। বিপুল অঙ্কের এই আমদানি ঘিরেই বড় ধরনের মূল্য কারসাজি হয়েছে। তবে আখ থেকে স্থানীয়ভাবে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ৩০ হাজার টন। এছাড়া সরু, মাঝারি ও মোটা এই তিন ধরনের চালের ক্ষেত্রে গত এক মাসে স্থানীয় বাজারে গড় মূল্য বৃদ্ধি পায় ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বিশ্ববাজারে বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। প্রতিবছরই প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়। উৎপাদন হয় ৩৭ কোটি ৬০ লাখ টন। এই আমদানি নিয়ে মূল্য কারসাজির কারণে পুরো চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি মূল্য কারসাজি হয়েছে আটা ও ময়দার বাজার ঘিরে। দেশে গমের চাহিদা ৬৫ লাখ টনের মধ্যে আমদানি করা হচ্ছে ৫৯ লাখ টন। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। তবে সম্প্রতি সেটি পর্যায়ক্রমে কমে আসে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে গমের মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বিপরীতে দেশের বাজারে খোলা আটার মূল্য ২৮ শতাংশ এবং ময়দা (প্যাকেট) ১৭ শতাংশ বাড়ানো হয়।
এছাড়া উন্নয়ন উপকরণ নির্মাণসামগ্রী রড ও সিমেন্টের বাজারও পর্যালোচনা করা হয়। দেশের বাজারে রডের মূল্য বেড়েছে ৩ শতাংশ। কিন্তু বিশ্ববাজারে বেড়েছে এক মাসে মাত্র দশমিক ৭৮ শতাংশ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পায় সিমেন্টের ক্ষেত্রে। অথচ দেশের বাজারে বেড়েছে ১৩ শতাংশ। অনুসন্ধানকালে তিনটি বিষয় সামনে রেখে আট পণ্যের মূল্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন কতটুকু হয়েছে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব এবং বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির তথ্য সমন্বয়। এসব তথ্য পর্যালোচনা করেছে বিটিটিসি। সেখানে দেখা গেছে, এই তিন সূচকের প্রভাবে বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য যেটুকু বৃদ্ধির কথা, তার চেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে পণ্যের মূল্য বাড়ছে। এছাড়া একশ্রেণীর ব্যবসায়ী অতিমুনাফার প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন। অপরদিকে অনেক ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। অসাধু ব্যবসায়ী এবং সিন্ডিকেটের প্রভাবে আজ বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।