কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজাকারদের তালিকা প্রকাশে আইনি বাধা কেটে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে এ তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী বিজয় দিবসকে টার্গেট করে প্রথম কিস্তির রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের তালিকা প্রকাশের কাজ চলছে। তবে, রাজাকারদের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণকারী খোদ সংসদীয় কমিটি বিতর্কমুক্ত তালিকা প্রকাশে সংশয় প্রকাশ করেছে। সংসদীয় কমিটির দাবি তারা রাজাকারদের তথ্য সংগ্রহে একাধিকবার যাছাই করেছে। তারপরও এটি নিয়ে কোনও বিতর্ক হবে না এমনটি বলা মুশকিল। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে এই তালিকা তৈরি করতে গিয়ে কিছুটা বিতর্ক উঠতেই পারে। এর আগে ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১০ হাজার রাজাকারের তালিকা প্রকাশ হলে ব্যাপক বিতর্কের মুখে তা স্থগিত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ- প্রথম পর্ব’ শিরোনামে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকের নাম রাজাকারের ওই তালিকায় স্থান পেয়েছে। আবার তালিকায় কুখ্যাত অনেক রাজাকারের নাম নেই। ফলে বিষয়টি নিয়ে সে সময় সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পরে তালিকা প্রকাশের তিন দিনের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক দুঃখ প্রকাশ করে ওই তালিকা স্থগিতের ঘোষণা দেন। মন্ত্রণালয় পরে প্রজ্ঞাপন জারি করে তালিকাটি স্থগিত করে।
তালিকা নিয়ে বিতর্ক হওয়ার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি নিজেদের উদ্যোগে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা প্রস্তুতের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে ২০২০ সালের ৯ আগষ্ট ৬ সদস্যের সাব কমিটি গঠন করা হয়। সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান নিজেই ওই সাব কমিটির আহ্বায়ক হন। ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, এবি তাজুল ইসলাম ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল এবং মোসলেম উদ্দিন আহমেদকে রাখা হয়। কিন্তু কোরাম সংকটের অভাবে ঠিকমতো বৈঠক না হওয়ায় চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ওই কমিটির আকার ছোট করে তিন সদস্যে নামিয়ে আনা হয়। শাজাহান খানের নেতৃত্বে নতুন সাব কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম।
এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের সব জেলা প্রশাসকদের একাধিক দফায় চিঠি দিয়ে তাদের দফতরে সংরক্ষিত স্বাধীনতাবিরোধীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি জেলা/উপজেলার যুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার ও দায়িত্বশীল মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই কাজটি শাজাহান খান নিজ উদ্যোগে করছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। তিনি এ পর্যন্ত ১৩০টি উপজেলা থেকে রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও এ বছর এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে জানিয়েছিলেন। ওই সময় পর্যন্ত সারা দেশ থেকে ২ হাজার ৫০৪ জন রাজাকারের তালিকা সংসদীয় কমিটি হাতে পায়। জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের মাধ্যমে সংগৃহীত তালিকা অধিকতর যাচাই করার জন্য আবারও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের কাছে পাঠানো হয়। ওই তালিকা এলে সেটা যাচাই-বাছাই করে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কাছে পাঠিয়ে তা চূড়ান্ত করে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করতে গিয়ে কমিটিকে আইনি বাধার মুখে পড়তে হয়। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল-জামুকার আইনে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি ও প্রকাশের বিধান থাকলেও আইনে রাজাকারদের তালিকা তৈরির কোনও বিধান ছিল না। পরে সরকার ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল-জামুকা আইন’ সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। গত ২৯ আগস্ট এই আইনটি পাস হওয়ার পর বিদ্যমান বাধা কেটে গেছে। এর ফলে সরকার নতুন করে রাজাকারদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান রবিবার (১১ সেপ্টেম্বর) বলেন, ‘জামুকা আইন সংশোধনে দেরি হলেও আমরা কাজ কিন্তু এগিয়ে রেখেছি। ১২৫টির মতো উপজেলার তালিকা সংগ্রহ করে রেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই জানিয়েছি, তালিকা একবারে প্রকাশ হবে না, পর্যায়ক্রমে করা হবে।’ যেগুলোর বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাবে সেগুলো আগে প্রকাশ করা হবে বলেও তিনি জানান।
চলতি বছর বিজয় দিবসের আগেই প্রথম কিস্তির তালিকা প্রকাশের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে শাজাহান খান বলেন, ‘আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর সাব কমিটির বৈঠক ডেকেছি। ওই বৈঠকের পর মূল কমিটিতে তালিকা উপস্থাপন করবো। সেখানে সিদ্ধান্তের পর সরকারের কাছে পাঠাবো। পরে জামুকার মাধ্যমে সেটি চূড়ান্ত করে সরকার এটি প্রকাশ করবে। আশা করছি, বিজয় দিবসের আগে আমরা আংশিক তালিকা প্রকাশ করতে পারবো।’
অতীতের তালিকা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আগে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছিল, এজন্য আমরা অধিকতর যাচাই করছি। তারপরও মনে হয়, কিছু এদিক-ওদিক হবে। সবাই যে আমাদের হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট তথ্য দেবে, সেটা তো বিশ্বাস করা যায় না। সারা দেশে ৫০০-এর মতো উপজেলার তথ্য কতটাই-বা গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হবে। আর এটা বুঝতে হবে ঘটনাটি ৫০ বছর আগে। তবে, সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমরা যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের প্রাধান্য দিচ্ছি। তাছাড়া সরকারের বিভিন্ন মাধ্যম থেকেও তথ্য নিচ্ছি।’