সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে নানামুখী শর্তের বেড়াজালে বিএনপি

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ১৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে আরও কয়েকটি দলের কাছে যাবেন বিএনপির নেতারা। এক্ষেত্রে নানামুখী শর্তের মুখে পড়তে হচ্ছে বিএনপিকে। কোনও কোনও দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী হলেও জামায়াত ইস্যুতে পিছিয়ে যাচ্ছে। আবার কোনও দলের সঙ্গে জামায়াতের বাধায় আলোচনায় আগ্রহ দেখাতে পারছে না বিএনপি। দলটির মতবিনিময়ের সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতা ও আগ্রহী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব বিষয় জানা গেছে।
বিএনপির প্রভাবশালী একাধিক দায়িত্বশীলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির মূল লক্ষ্য দুটো। একটি হচ্ছে, আগামী নির্বাচনের আগে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রিত করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, দাবি আদায়ে দলগুলোর মধ্যে যুগপৎ কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজপথে কর্মসূচি প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে দুটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বিএনপি।
দায়িত্বশীলরা জানাচ্ছেন, সমস্যা দুটি হচ্ছে জামায়াত ইস্যু ও নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি। বাম ও প্রগতিশীল ধারার বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনা হলেও সিপিবি ও বাসদকে এখনও আলোচনার দৃশ্যমান টেবিলে আনতে পারছে না বিএনপি। দল দুটোর পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গটি থাকলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। আর এ কারণে সিপিবি ও বাসদের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান আলোচনায় সাড়া মিলছে না।
সিপিবির সাবেক একজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যের আলোচনা এগোলেও দলটির নবনির্বাচিত নেতৃত্বের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পায়নি বিএনপি। যদিও বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার দাবি, ‘সিপিবি ও বাসদ বিএনপিকে হতাশ করেনি। তারা ধরেনি, ছাড়েওনি।’
দ্বিতীয় ইস্যুটির প্রসঙ্গে সূত্রের দাবি, বিএনপির প্রতি অন্য দলগুলোর বড় আহ্বান হচ্ছে আস্থা ফেরানো। বিশেষ করে নির্বাচন পরবর্তী ইতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি হলে দুর্নীতি, জুলুম-নিপীড়ন ও স্বজনপ্রীতি না করার বিষয়ে পরিষ্কার প্রতিশ্রুতি চায় বিরোধী দলগুলো।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সিপিবির সঙ্গে বিএনপির কোনও আলোচনা হয়নি। আমরা দ্বিদলীয় শক্তির বাইরে ভিন্ন শক্তি গড়ে তুলতে চাই। ব্যবস্থা বদল করতে চাই। সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা বদলের কথা হলে আলোচনা হতে পারে। সিপিবির রাজনীতির সপক্ষে হলে আমরা ভাববো।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো বলেই দিয়েছি আন্দোলন হবে যুগপৎ ধারায়। এক প্ল্যাটফর্মে তো কেউ নেই। জামায়াত এখন প্রবলেম না, যার যার জায়গা থেকে সবাই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। জামায়াত আন্দোলন করতে চাইলে তাদের জায়গা থেকে করবে।’
আরও মতবিনিময় হবে, আছে ‘জামায়াতের চাপও’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, মতবিনিময়ের প্রথম পর্ব শেষ হলে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। প্রথম পর্বে যেসব দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, আলোচনায় সম্মতি দিয়েছে, তাদের রূপরেখা দেওয়া হবে। সেই রূপরেখার আলোকে দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা শুরু হবে।
দলের চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং ও দলের মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, চলমান মতবিনিময়ের অংশ হিসেবে আগামী ২৪ জুলাই জেএসডি সভাপতি আসম আব্দুর রবের সঙ্গে তার বাসায় সাক্ষাৎ করবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার সঙ্গে মতবিনিময়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও অংশগ্রহণ করবেন।
দলীয় সূত্র জানায়, জেএসডির পর রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিএনপি নেতারা। ইতোমধ্যে আলোচনার দিনক্ষণ ঠিক হলেও মির্জা ফখরুলের অসুস্থতার কারণে তা হয়নি। এ কারণে নতুন তারিখে মতবিনিময়ে অংশ নেবেন দুই দলের নেতারা।
বিএনপির একজন দায়িত্বশীল জানান, বিএনপি জোট ছেড়ে যাওয়া বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থর সঙ্গেও কথা বলবে বিএনপির প্রতিনিধি দল। ১৪ দলীয় জোট ছেড়ে আসা শরিফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা রয়েছে বিএনপির। তবে তারিখ নির্ধারণ হয়নি। এছাড়া বিএনপি জোটের কয়েকটি শরিক দলের সঙ্গেও পৃথকভাবে কথা বলবেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। এক্ষেত্রে ‘আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বাধীন এলডিপির (একাংশ) সঙ্গে আলোচনা করার সম্ভাবনা নেই’ বলে এ প্রতিবেদককে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন দায়িত্বশীল জানান, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় নিয়ে এখনও স্পষ্ট নয় বিএনপি। কোনও কোনও দলের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা হলেও দলীয়ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ইসলামি দলগুলোর ক্ষেত্রে কী অবস্থান হবে, তা এখনও নির্ণয় করতে পারেননি দলটির নেতারা।
এদিকে, কোনও কোনও দলের সঙ্গে বিএনপি যেন মতবিনিময় না করে, সে ব্যাপারে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ইতোমধ্যে জামায়াতের বিরোধী একটি দলের সভায় বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা বক্তব্য রাখার পর তা প্রচার না করার অনুরোধ জানান তিনি নিজেই। জামায়াত এখনও জোটসঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তিনি এ অনুরোধ করেন বলে একজন নেতা জানান।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের অংশ হিসেবে বিএনপির সিনিয়র তিন জন নেতা কথা বলেছেন নতুন গঠিত আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) একাধিক নেতার সঙ্গে। ব্যক্তিগত আলাপে তিন নেতা দলটির সঙ্গে আলোচনা করার কথা বললেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রক্রিয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মনজু বলেন, ‘বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও আলোচনা হয়নি। যেকোনও ধরনের সংলাপে, আলোচনায় আমরা ইতিবাচক। সংলাপকে রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করি। তবে আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের সঙ্গে সংলাপে জামায়াতের তীব্র আপত্তি আছে।’
যদিও বিএনপির একটি সূত্র দাবি করছে, এবি পার্টি শেষ মুহূর্তে ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে নির্বাচনে যেতে পারে। একইসঙ্গে এবি পার্টি বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। এসব আলোচনার নেপথ্যে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে মজিবুর রহমান মনজুর ভাষ্য, ‘এরকম আলোচনা আমরা শুনি। আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, বিএনপি যদি নির্বাচনেও যায়, তাহলে আমরা যাবো, তা নয়। আমাদের দাবি, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন।’
বিএনপির একজন দায়িত্বশীল জানান, প্রথম পর্বে আলোচনার পর দ্বিতীয় পর্বের মতবিনিময় শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্বে বৃহত্তর ঐক্যের এজেন্ডা, রূপরেখা ও একটি সমন্বয় কমিটি গঠন নিয়ে কাজ শুরু হবে। কমিটিতে বিএনপির পক্ষ থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রতিনিধি হিসেবে থাকতে পারেন।
জানতে চাইলে শুক্রবার (২২ জুলাই) সন্ধ্যায় ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে সবকিছু মহাসচিব বলবেন। তিনি মুখপাত্র হিসেবে বলেছেন, অল্প কিছু দিনের মধ্যে মতবিনিময় শেষ হবে। এরমধ্যে বন্যার কারণে ব্রেক ছিল। বাকিগুলোও শেষ হবে। দ্বিতীয় ধাপে মতবিনিময় হবে কিনা, জানি না। প্রয়োজন হলে হবে। কী কথাবার্তা হচ্ছে, সেটা এখনও স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়নি। এগুলো আলোচনা হলে বোঝা যাবে কী হবে।’