সুনামগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গত ১৬ জুন থেকে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে মানুষের দুর্গতি পিছু ছাড়ছে না। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলায় ৯৫ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় অর্ধ লাখ বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার ভয়াবহ বন্যায় আগের সব ক্ষয়ক্ষতির রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
বন্যার পানি কিছুটা কমলেও বাড়িঘর সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত হওয়ায় এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজের ভিটায় ফিরতে পারছেন না। কষ্টের গড়া নিজ ঘরে অবস্থান করতে না পারা শ্রমজীবী, দরিদ্র মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছেন। এছাড়াও সড়ক, মাছ ও গৃহপালিত পশু পাখির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখনও অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছে বানভাসি মানুষ।
জেলায় সরকারি হিসাবে বন্যায় সাড়ে চার লাখ মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরবাড়ির। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন, যা এর আগে একাধিক বন্যা হলেও এত ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়নি।
জেলার ১২টি উপজেলার চার হাজার ৭৪৭টি বসতঘর সম্পূর্ণ ও ৪০ হাজার ৫৪১টি বসতঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি সম্পূর্ণ কমে গেলে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো জেলার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি ও ত্রাণ তৎপরতা সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় জেলায় ২৫ হাজার ২০৪টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বন্যায় এক হাজার ৬৪২টি গবাদিপশু মারা গেছে। এর মধ্যে গরু ৪২২টি, মহিষ ৩৭টি, ছাগল ৬৬৯টি ও ভেড়া ৫১৪টি। এছাড়া বন্যায় ২৮ হাজার ৮০৫টি মুরগি ও ৯৭ হাজার ৮৩১টি হাঁস মারা গেছে। বন্যায় জেলায় এ পর্যন্ত ৩৮৪ কিলোমিটার সড়ক, ১৫৫টি সেতু কালভার্টের সংযোগ সড়ক এবং চারটি সেতু-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে নগদ ৫৫ লাখ টাকা, ৫০ হাজার ১২ প্যাকেট গুঁড়া দুধ পাওয়া গেছে। এসব নগদ টাকা ও সামগ্রী প্রতিটি উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া এক হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। নগদ টাকা পাওয়া গেছে এক কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা।
এ পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া ১১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, সাড়ে ১৪ কেজির খাদ্যসামগ্রীর ২৮ হাজার বস্তা, ১০ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং আরও ১০ লাখ টাকার গোখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্যাদুর্গতদের মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে সাত হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে । এর বাইরে বেসরকারিভাবে এ পর্যন্ত নগদ ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা, দুই লাখ ৬১ হাজার ৯৩৬ প্যাকেট খাবারের পাশাপাশি ২৬ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
হাওর বেষ্টিত তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমদ মোরাদ জানান, আমার ইউনিয়নটি হাওর বেষ্টিত থাকায় এবার আমার ইউনিয়নের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারের অবস্থায় এখন খুবেই করুন। তাদের মাটির বসত বাড়ি গৃহপালিত পশু পাখির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল জানান, এবার বন্যায় জেলায় সড়ক, পশু-পাখি, বসত বাড়ি, ফসলের ও মাছ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আর ক্ষতির পরিমান হাওর এলাকায় বেশি। তাহিরপুর উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই হাওরের ডেউয়ে বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য আমি আমার সাধ্য মতো সর্বোচ্চ মহলে কথা বলব ও সহায়তার চেষ্টা চালিয়ে যাব।
আমাদের পক্ষ থেকে কঠোর নজরধারী রাখার পাশাপাশি সহায়তা বিতরণ অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সার্বিক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চলে এখনও বন্যার পানি আছে। ফলে কিছু মানুষ এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন।
জেলা প্রশাসক জানান, এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের তালিকা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দেওয়া হয়েছে। শিগরিরই তাদের মধ্যে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে যাতে তারা বাড়িঘর মেরামত এবং অর্থ দিয়ে জীবন বাঁচাতে পারেন।