স্টাফ রিপোর্টার :
নগরী, শহরতলী ও সিলেট জেলায় আস্তে আস্তে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। প্লাবিত নিন্মঞ্চল থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। আগামী ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার সম্ভবনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জমে থাকা বন্যার পানি আর ময়লা-আবর্জনা মিলেমিশে পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর নতুন করে মানুষজনের দাঁড়িয়েছে দুর্ভোগ।
এদিকে পানি নেমে যাওয়ায় নিজেদের বাসা-বাড়িতে ফিরছেন নগরবাসী। কিন্তু বাসা-বাড়িতে গিয়ে স্বস্তি নেই তাদের। কয়েকদিন বন্যার পানির সাথে ময়লা-আবর্জনা জমে থেকে পচে গেছে। অনেক স্থানে খানাখন্দ বা ড্রেনে জমে থাকা পানি পচে গিয়ে কালো রং ধারণ করেছে। পচে যাওয়া আবর্জনা ও পানি থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। শুধু তাই নয় নগরীর তালতলা ফায়ার সার্ভিস ও এর আশপাশ এলাকার বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেলে পানি নেমে যাওয়ায় ময়লা-আবর্জনা আটকে গেছে।
নগরীর জামতলার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন বলেন, পানি সরে যাওয়ায় বাসায় ফিরেছি। কিন্তু এখন পড়েছি নতুন দুর্ভোগে। চারদিকে গলে-পচে যাওয়া ময়লা-আবর্জনা থেকে ছড়াচ্ছে উৎকট গন্ধ।
ছড়ারপারের আখলুছ মিয়া বলেন, বাসায় পানি ঢুকে পড়েছিল। বন্যার নোংরা পানি নেমে গেলেও এখন বাসায় ফিরে দেখি দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে আছে। বাসা পরিষ্কার করা নিয়ে এখন ব্যস্ত।
নগরীর বন্যা কবলিত এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ব্লিচিং পাউডার দিয়ে তারা এখন নিজেদের বাসা-বাড়ি পরিষ্কার করছেন। আসবাবপত্র ধোয়ামোছার কাজও চলছে। যাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছিল, তারাও এখন পরিষ্কারকরণে ব্যস্ত।
নগরীবাসির দাবি, যেসব এলাকায় বন্যার পানি ছিল সেসব এলাকার ড্রেনগুলো যাতে দ্রুত পরিষ্কার করা হয়। একইসাথে এসব এলাকার সড়কে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে পরিষ্কার যাতে করা হয়। তাতে দুর্গন্ধ কমবে।
জানা গেছে, গত ১০ মে থেকে সিলেটে টানা বর্ষণ শুরু হয়। এর সাথে উজান থেকে নেমে আসে ঢল। এ দুয়ের ফলে পানি বাড়তে শুরু করে। ২ থেকে দিনের মধ্যে প্লাবিত হয়ে যায় নগরী ও সিলেটের জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো। সিলেট সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলেও দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টি ও ঢল না থামায় পরিস্থিতি মোড় নেয় ভয়াবহতার দিকে। সুরমা নদীর তীর উপচে পানি ঢুকে পড়ে সিলেট নগরীতেও। তলিয়ে যায় নগরীর নিন্মঞ্চলগুলো। প্রায় এক সপ্তাহের অবর্ণণীয় দুর্ভোগ শেষে গত শুক্রবার রাত থেকে কমতে শুরু করে পানি। গত শনিবারও পানি কমা অব্যাহত ছিল। গতকাল রবিবার কমছে পানি। প্লাবিত অনেক অঞ্চল থেকেই এখন পানি নেমে গেছে। নগরীর সিংহভাগ এলাকাই এখন পানিবন্দি পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা বলেন, বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। পানি দ্রুত নেমে যেতে শুরু করেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দ্রুতই পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, নগরীর সিংহভাগ এলাকা থেকেই পানি নেমে গেছে। নগরবাসী আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজেদের বাসা-বাড়িতে ফিরছেন। আজকের মধ্যেই আশ্রয়কেন্দ্র খালি হয়ে যেতে পারে।
এদিকে, সুরমা, কুশিয়ারাসহ সিলেটের নদীগুলোর পানিও কমছে। গত শনিবার সকালের চেয়ে গতকাল রবিবার সকালে পানি কয়েক সেন্টিমিটার কমেছে।
এদিকে নগরী থেকে ৮০ শতাংশ বানের পানি নেমে গেছে। বাসাবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। তবে নিম্নাঞ্চলের কিছু সড়ক ও বাসাবাড়িতে এখনও পানি রয়ে গেছে। বন্যায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মাছের খামারের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। কৃষকরা আউশ ফসলের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ১১টি উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দীঘি, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বলে মাছ মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে খামারের। বন্যায় ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে, নগরীর বাসাবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি নামার পর জমে থাকা ময়লায় চরম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। একই সঙ্গে পানিতে ভিজে আসবাবপত্রের ক্ষতি হয়েছে। বাসাবাড়ি, দোকানপাট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন সংশ্লিষ্টরা।
পানি নেমে যাওয়ায় নগরীর পরিস্থিতির উন্নতি হলেও উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। জেলায় বন্যার পানি কোথাও বেড়েছে, আবার কোথাও অল্প কমেছে। গত শুক্রবার রাতে ভেঙ্গে যাওয়া জকিগঞ্জের অমলশিদ এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থলের বাঁধ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। ওদিকে, নতুন করে ভাটির দিকে চাপ বেড়েছে পানির।
এদিকে, তিন নদীর মোহনায় বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় জকিগঞ্জে ২৯৩টি গ্রামের মধ্যে দুই শতাধিক গ্রামই এখন প্লাবিত। সব মিলিয়ে উপজেলার প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। প্লাবিত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য মানুষ হাহাকার করছে। জকিগঞ্জ ছাড়াও পানি বেড়েছে বিশ্বনাথ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়। গত দুইদিনে এসব উপজেলায় অন্তত ১৫ থেকে ২০টি গ্রাম নতুনভাবে প্লাবিত হয়েছে। জেলার অন্যান্য উপজেলার কোথাও পানি কমেছে, কোথাও পানি বাড়ছে। বানভাসি মানুষরা জানিয়েছেন, কিছু এলাকায় পানি কমলেও তার পরিমাণ খুব কম। ফলে ঘরবাড়ি থেকে পানি এখনও সরেনি। এ অবস্থায় ভোগান্তি ঠিক আগের মতোই আছে।
গত দুদিন কমার পর রবিবার আবার বাড়ছে সিলেটের সুরমা নদীর পানি। শনিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে সিলেট পয়েন্টে এ নদীর পানি অপরিবর্তিত আছে। অপরদিকে, ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে কুশিয়ারার পানি বাড়ায় বাঁধ ভেঙ্গে ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ নতুন করে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলছেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আর খুব একটা অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। ৪/৫ দিনের মধ্যে বেশিরভাগ এলাকা থেকেই পানি নেমে যাবে। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ায় বানভাসিদের সঙ্কট আরও বেড়েছে। ত্রাণ নিয়ে হাহাকারও দেখা দিয়েছে অনেক জায়গায়। এখন পর্যন্ত ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকে। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক ও মৎস্যজীবীরা। বোরোর পর তলিয়ে গেছে আউশ ধানের বীজতলা। এ ছাড়া ভেসে গেছে হাজারও খামারের মাছ।
১৪০টি মেডিকেল টিম : বন্যায় সিলেটে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে জানিয়ে সিলেটের সিভিল সার্জন ডাঃ এস এম শাহারিয়ার বলেন, ইতোমধ্যে শতাধিক লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আমরা পেয়েছি। চর্মরোগও বাড়ছে। পানি কমলে রোগবালাই আরও বাড়তে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পানিবাহিত রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, এ জন্য আমরা এরই মধ্যে ১৪০টি মেডিকেল টিম গঠন করেছি। তারা বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার্তদের সেবায় কাজ করছে।
ত্রাণের কোন সঙ্কট নেই : ত্রাণের কোন সঙ্কট নেই জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোঃ মজিবর রহমান বলেন, শনিবার পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে ৩২৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৫ লাখ টাকা ও সাড়ে ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখনও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণ দেয়া হবে।
২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি : আকস্মিক বন্যায় সিলেটের ১১টি উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দীঘি, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে মাছ চাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও হয়েছে অবকাঠামোগত ক্ষতি। এর ফলে সিলেট জেলার ১৫ হাজার ১৬৩ জন খামার মালিকের ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম আজাদ।
এদিকে, বন্যায় মাছের খামার, পুকুর ও দীঘি তলিয়ে মাছ চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অনেক এলাকায় বন্যার পানিতে মাছ ধরার হিড়িক পড়েছে। খামার থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাছ ধরা পড়ছে বিভিন্ন এলাকায় লোকজনের জালে। বন্যাকবলিত প্রায় প্রতিটি স্থানে অবাধে শিশু-কিশোর ও যুবককে ছোট ছোট জাল নিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে।
সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে সুরমা নদীর পানি সিলেটের সব পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, রবিবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা পয়েন্টে ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর ও সিলেট নগরী পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি সিলেটের জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপর এবং বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে হাওরপারের গ্রামগুলোতে দুর্ভোগ বেড়েছে : নদীর পানির কমলেও হাওড়পাড়ের গ্রামগুলোতে দুর্ভোগ বেড়েছে। গেল ১০/১২ দিনের লাগাতার বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নাভিশ^াস অবস্থা চলছে হাওড়ের জনপদে।
অনেক সড়ক ডুবে আছে, সড়কের ওপর দিয়ে যানবাহন চলছে না, আবার নৌকাও যাচ্ছে না, তাতে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা দেয়া হচ্ছে বলা হলেও বন্যাদুর্গতরা বলছেন, তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। সরকারী-বেসরকারী যে সব ত্রাণ যাচ্ছে, তা কেবল শহর ও শহরতলিতে পৌঁছাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের বন্যকবলিতরা তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হেসেন তা অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি ও পৌর মেয়র নাদের বখত রাতেও মানুষের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বললেন, রবিবার আবহাওয়া একই ধরনের থাকবে। তবে ২৩, ২৪ ও ২৫ মে বৃষ্টি কমবে। এই তিনদিন উজানেও (মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতে) বৃষ্টি কম হবে।