কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের মেগাসিটি হিসেবে পরিচিত প্রায় দুই কোটি জনঅধ্যুষিত রাজধানী ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির তালিকা অনুয়ায়ী রাজধানীতে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ৫১ গডফাদার। ঢাকার ৮ বিভাগে রয়েছে ৭৮টি গ্যাং। ঢাকার ৫০ থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। আছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও। পুলিশের প্রস্তুত করা একটি ডাটাবেজে দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার রয়েছে আওয়ামী লীগের ১১ জন, ছাত্রলীগের ১৬ জন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৫ জন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ৪ জন, যুবলীগের ৭ জন, বিএনপির ১ জন, যুবদলের ১ জন, শ্রমিক লীগের ১ জন এবং রাজনৈতিক পরিচয় নেই এলাকায় প্রভাবশালী এমন ৫ জন। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করার অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের ওপর নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে পুলিশকে। পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মিরপুরের ৭টি থানায় সর্বোচ্চ ২৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর সদস্য সংখ্যা ১২০ জন। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ৬টি থানায় রয়েছে ১৪টি কিশোর গ্যাং। এর সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৫০ জন। উত্তরা বিভাগের ৫টি থানায় ১১টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর সদস্য সংখ্যা ৩২০ জন। গুলশান বিভাগে রয়েছে ১টি কিশোর গ্যাং। এর সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। ওয়ারী বিভাগের ৫টি থানায় ৬টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর সদস্য সংখ্যা ১০০ জন। মতিঝিল বিভাগের ৬টি থানায় রয়েছে ১১ টি কিশোর গ্যাং। এর সদস্য সংখ্যা ৯০ জন। রমনা বিভাগের ৪টি থানায় ৮টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর সদস্য সংখ্যা ১৪০ জন। লালবাগ বিভাগের ৩টি থানায় ৪টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন।
ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মিরপুর থানা এলাকার বগা হৃদয় নামে একটি গ্রুপ আছে। গ্রুপটি কল্যাণপুর পোড়া বস্তি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রুপটি নিয়ন্ত্রণ করেন একজন ছাত্র নেতা, যিনি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। ভাস্কর গ্রুপ নামে অপর একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ আছে। এই কিশোর গ্যাং মিরপুরের ওয়ালাপাড়া ও ধানক্ষেত মোড় নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণ করেন একজন কাউন্সিলর। দারুস সালাম থানার এলকে ডেভিল বয়েজ গ্রুপের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন একজন স্থানীয় ছাত্র নেতা। অপর একটি গ্রুপ লালকুঠির তৃতীয় কলোনি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। পটেটো রুবেল গ্রুপের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আছে। এই গ্রুপ ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি, বসুপাড়া ও খালেক সিটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। অতুল গ্যাং নামে একটি গ্রুপ আছে। এই গ্রুপ ইব্রাহিমনামা, মতিননামা এবং তিনতলা মসজিদ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রুপের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আছে। কিশোর গ্যাং অপু গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে রিপন ওরফে দাদা রিপন। এছাড়া কিবরিয়া ওরফে পিয়াসের নাম রয়েছে। এই গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে কল্যাণপুর নতুনবাজার ও ১১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা। নাভানা আবাসিক এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী কিশোর গ্যাং আশিক গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পল্লবী থানা এলাকার একজন স্থানীয় ছাত্র নেতা।
পুলিশের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, রকি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আছে ১২ নম্বর সেকশনের বি-ব্লক এবং বিবাহবাড়ি কমিউনিটি সেন্টার এলাকা পিন্টু ও কালু গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন একজন যুব নেতা। এই গ্রুপ ১১ নম্বর সেকশনের ব্লক বি’র ঈদগাহ্ মাঠের পশ্চিমপাশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। ভাই ভাই গ্রুপের প্রধান রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন একজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা। এই গ্রুপটি ডি-ব্লকের আরবান শিশুপার্ক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। রোমান্টিক গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন জালাল উদ্দিন বিটু। তিনি বিহারী ক্যাম্পের চেয়ারম্যান। এই গ্রুপ কুর্মিটোলা ক্যাম্প ও তার আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।
পুলিশের ক্রাইম খাতা অনুযায়ী, সোহেল গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আছে চলন্তিকার আশপাশের এলাকা। এছাড়া সোহেল ওই এলাকায় ইয়াসিন গ্রুপও নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রুপের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন স্থানীয় এক ছাত্র নেতা। ইমন গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন সুমন মোল্লা। তিনি রূপনগর ওয়ার্ড ছাত্র নেতা। এই গ্রুপ রূপনগর আবাসিক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। জুয়েল গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শাহ্ আলী থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন স্থানীয় নেতা। এই গ্রুপ গুদারাঘাট ও কাজীফরীবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। গুলশানের ডি-নাঈম গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন সাইদুল ইসলাম। পুলিশ তার নামের পাশে রাজনৈতিক নেতা বললেও তিনি কোন দলের তা উল্লেখ করেনি। তার নামের পাশে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা তাদের লালন-পালন করে থাকে বলে উল্লেখ করেছেন। এই গ্রুপটি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং ছোলমাঈদ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বলে পুলিশের খাতায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তেজগাঁও থানাধীন কাওরানবাজার নিয়ন্ত্রণ করা কানা জসিম কিশোর গ্যাং গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক লিটু। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর এলাকার যুব নেতা। ফার্মগেট, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া ও তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনি নিয়ন্ত্রণ করা মাইন গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার শাকিল গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পুলিশের খাতায় নাম রয়েছে এক ছাত্র নেতার। এই গ্রুপটি পদ্মা গার্মেন্টস, সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল, ইয়াং স্টার স্পোর্টিং ক্লাবের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করে। ওই থানাধীন নাবিস্কো মোড়, নিপ্পন বটতলা, প্রগতি মোড় ও নূরানী মোড় এলাকার নিয়ন্ত্রণ করা মামুন গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তালুকদার সারোয়ার হোসেন। মোহাম্মদপুর থানাধীন কিশোর গ্যাং গাংচিল গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন চন্দ্রিমা হাউজিং ও সিলিকন হাউজিংয়ের মালিক ছারোয়ার ও নাজিব আমজাদ এবং গ্রাম বাংলা হাউজিংয়ের কবীর। চক্রটি চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, একতা হাউজিং ও বেড়িবাঁধসহ আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুঁটা দে গ্যাং গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক ড্রিমল্যান্ড হাউজিংয়ের এক কর্মকর্তা। ঘুঁটা দে গ্রুপ ওই নবোদয় হাউজিং, নবীনগর হাউজিং ও চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, হাতিরঝিল এলাকায় রয়েছে কিশোর গ্যাং গ্রুপের উৎপাত। পলক গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ক্ষমতাসীন দলের এক স্থানীয় নেতা। গ্রুপটি পশ্চিম রামপুরা এলাকার মক্কি মসজিদ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশ বেতার, বিএনপি বস্তি ও খালপাড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে শেরেবাংলা গ্রুপ-১ এবং এর পৃষ্ঠপোষক শেরে বাংলানগর থানার স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবক নেতা। আদাবরের শেখেরটেকের মনসুরাবাদ এলাকার কিশোর গ্যাং ‘দ্যা কিং অব গাইরালা’ গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এছাড়া ওই কাউন্সিলর শ্যামলী ও নবোদয় হাউজিং এলাকায় ভইরা দে গ্রুপ লালনপালন করে। অনলি কোপাইয়া দে গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন এক ওয়ার্ড যুব নেতা। এই গ্রুপটি সুনিবিড় হাউজিংয়ের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। সোহওাওয়ার্দী উদ্যানে অলি গ্রুপ নামে একটি গ্যাং গ্রুপ সক্রিয়।