কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারা বিশ্ব উন্নয়ন দেখলেও দেশের একটি শ্রেণী তা দেখে না, তারা অন্ধ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। দেশের উন্নয়ন যারা দেখে না তাদের আগাছা-পরগাছার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, আগাছা কী করতে হবে সেটা কিন্তু বাঙালির নিজেকেই ভাবতে হবে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত ভাষা দিবসের আলোচনায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালি যখনই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তখনই চক্রান্ত শুরু হয়। বাঙালির মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছেন, যেকোন অর্জন তাদের কাছে ভাল মনে হয় না। তারা পরাধীনতার মধ্যে থাকতে চায়। তিনি বলেন, একটা শ্রেণী আছে, যারা আত্মমর্যাদা নিয়ে থাকতে চায় না। আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে তুষ্টি পায়। তারা এই অর্জনের কথা বলতেও যেন দ্বিধান্বিত। এরা কেন এরকম, সেটা আমার নিজের কাছেও প্রশ্ন।
গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভায় ভাষার লড়াই, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্বীকৃতির কথা তুলে ধরে বলেন, যারা রক্ত দিয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা এই স্বীকৃতি পেয়েছি। এই মর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, বাংলাদেশের মাটি এত উর্বর, এতে ভাল ফল হয়, আগাছা-পরগাছাও হয়। আমরা স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই। শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চায় বাঙালি বিশ্ববাসীর সামনে স্বমহিমায় গৌরবে মাথা উঁচু করে চলবে এটাই চাই।
শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু একটি বিষয় সকলকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যখনই বাঙালি কিছু পায় বা মর্যাদা অর্জন করে বা বাঙালি এগিয়ে যেতে থাকে উন্নয়নের দিকে তখনই কিন্তু আবার অনেক চক্রান্ত ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আবার আমাদের কিছু, ভেতরে তো সবসময় থাকে, এই বাঙালির মধ্যেই কিছু থাকবে যে, অর্জনটা তো তাদের কাছে বোধ হয় মনঃপুতই হয় না। কারণ পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থাকতেই তারা পছন্দ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এই ধরনের মানসিকতায় ভোগে, জাতির পিতা কিন্তু একটা কথা বলতেন যে, বাংলাদেশের মাটি এত উর্বর, এখানে যেমন অনেক ফসলও হয়, আবার সেখানে পরগাছা, আগাছাও জন্মে। এই আগাছা থাকবে, এটা ঠিক। কিন্তু আগাছা কী করতে হবে, সেটা বোধ হয় বাঙালির নিজেই ভাবতে হবে। কারণ, আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে চাই। শিক্ষা-দীক্ষায়, সাংস্কৃতিক চর্চায় সবদিক থেকে বাঙালি নিজের মর্যাদা নিয়ে স্বমহিমায়, স্বগৌরবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলবে, এটাই আমাদের কামনা। এটাই আমরা চাই। আর ভাষা শহীদের প্রতি, জাতির পিতার প্রতি এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
বঙ্গবন্ধু বাংলাকে খুব ভালভাবে জানতেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ছয় দফা দাবি উত্থাপনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। মাত্র ছয়টি দফাতেই তিনি বাঙালির সব দাবি তুলে ধরেছিলেন। একইভাবে ৭০ এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মাত্র দুটো সিটে জিততে পারব না। এটা বলতে পেরেছিলেন। ৭০ এর নির্বাচনে সেটি মিলেও গিয়েছিল। এরপর তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন ঠিকই, কিন্তু তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এরপর ৭ মার্চের ভাষণ। সেটি আজ প্রামাণ্য দলিলের স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে আমাদের তিনি স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুললেন। তারপরেই ’৭৫’র ১৫ আগষ্ট। এই ঘটনার পরপরই আমাদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কথাও মুছে ফেলা হয়। কিন্তু জাতির পিতা বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। কেউ পারেওনি। বাঙালি মর্যাদা নিয়ে এগিয়ে গেছে। সেটা দিয়ে গেছেন জাতির পিতা শেখ মুজিব। মনে রাখবেন, কোন সংগ্রাম বৃথা যেতে পারে না।
সভা শেষে তিনি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বলেন, এখন থেকে বাংলাদেশ চিরজীবী হোক লাগবে না। নেতাকর্মীরা শ্লোগানের উত্তরে ক্ষীণ স্বরে ‘জয় বাংলা’ বললে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়াজ কই। এরপর তিনি আবারও জয় বাংলা’ শ্লোগান দিলে নেতাকর্মীরা জোরে করে ‘জয় বাংলা’ বললে তিনি হাতে তালি দিয়ে বলেন, ‘এই তো’। তিনি বলেন, ‘এখন থেকে আর বাংলাদেশ চিরজীবী হোক বলা লাগবে না, ‘জয় বাংলা’ বললেই হবে।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা এবং বর্তমানে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, কোন সংগ্রাম এবং রক্তদান কখনও বৃথা যায় না, বৃথা যেতে পারে না। যদি সততার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া যায়, যেকোন অর্জন করা সম্ভব। আর সেই অর্জনটা আমরা করতে পেরেছি। ’
পাকিস্তান গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্ভাগ্য হলো আমাদের যারা আঁতেল শ্রেণী তারা এগুলোকে কোনদিন মূল্যই দেয়নি। আমি যখন এই রিপোর্টগুলো পেলাম, আমি আর বেবী মওদুদ এই তথ্যগুলো পেয়ে আমি একটা বক্তৃতা দিলাম বাংলা একাডেমিতে। তো আমার সেই ভাষণের পর বদরুদ্দীন উমর আমার বিরুদ্ধে একটা বিরাট আর্টিকেল লিখল যে, এই কথা নাকি আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। শেখ মুজিবের কোন অবদান ভাষা আন্দোলনে নাই।
শেখ হাসিনা বলেন, কিন্তু ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্ট তো শেখ মুজিবের বিরুদ্ধেই আছে। আর কারও বিরুদ্ধে তো এত নাই। তার বিরুদ্ধেই তো লিখেছে-তিনিই ছাত্রদের উস্কানি দিচ্ছেন, তিনিই আন্দোলন করছেন, তিনিই সবখানে যাচ্ছেন, লিফলেট তৈরি করা, রেজুলেশন তৈরি করে সেগুলো সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছেন। বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এর মাঝে অনেক বার গ্রেফতার হয়েছেন আবার মুক্তি পেয়েছেন। আজকে ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চের রিপোর্টগুলো যদি আমি প্রকাশ না করতাম, তাহলে বোধ হয় এই তথ্যগুলো অধরাই থেকে যেত। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ওই ডায়েরিটা বের করার পর মানুষ অনেক সত্য জানতে পেরেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্যকে কখনও মুছে ফেলা যায় না।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্ত থেকে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রহমান, খায়রুজ্জামান লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা, আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং আবু আহাম্মদ মন্নাফি। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।