কাজিরবাজার ডেস্ক :
অবশেষে নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য ১০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করেছে সার্চ কমিটি। মঙ্গলবার বিকেলে সুপ্রীমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত কমিটির শেষ বৈঠকে ব্যাপক পর্যালোচনার পর ১০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। তবে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। তালিকাটি সার্চ কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের হেফাজতে রয়েছে বলে মন্ত্রীপরিষদ সচিব জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার এই তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। এ দিন সার্চ কমিটির সদস্যরাও বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত করবেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সার্চ কমিটির কাছ থেকে পাওয়া তালিকা থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চারজনকে কমিশনার নিয়োগ করবেন। এ দিকে নতুন নির্বাচন কমিশনে কারা আসছেন- তা দেখার জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষ ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এর আগে রবিবার অনুষ্ঠিত সার্চ কমিটির বৈঠকে ব্যাপক পর্যালোচনা করে ১২-১৩টি নামের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। সেখান থেকেই মঙ্গলবার ১০ নাম চূড়ান্ত করা হয়। তবে ১০ নাম চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই নতুন নির্বাচন কমিশনে কারা আসছেন, তা নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে। এমনকি, সার্চ কমিটির বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল বিএনপিও নতুন নির্বাচন কমিশনে কারা কারা আসছেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
মঙ্গলবার সুপ্রীমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সার্চ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকের পর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০ নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে এই তালিকা প্রকাশ করা হবে না। ১০ জনের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। তিনি সেখান থেকে বাছাই করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করবেন। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত করবেন সার্চ কমিটির সদস্যরা।
সার্চ কমিটির সভাপতি আপীল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক।
সার্চ কমিটির তালিকায় কোন ১০ জনের নাম আছে, তা প্রকাশ না করায় এ তালিকায় কারা আছেন, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক গুঞ্জন। এতে অনেকের নামই উচ্চারিত হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশনের সিইসি হিসেবে সবচেয়ে বেশি গুঞ্জন রয়েছে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়ার নাম। তিনি ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সচিব ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন বিসিএস (প্রশাসন) ৮১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা। তাই তাকে সিইসি নিয়োগ করলে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব ও বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সফিউল আলমের নামও সম্ভাব্য সিইসি হিসেবে জোরালো আলোচনায় আছে। তিনি ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিনয়ী, সৎ ও সজ্জন সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ ছাড়া সম্ভাব্য সিইসি হিসেবে আলোচনায় আছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব আবদুল করিম, নজিবুর রহমান ও সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যান ও নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকের নাম। আরও রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মমতাজউদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব শেখ ওয়াহেদুজ্জামান, সাবেক সচিব আবুল আলম শহীদ খান, সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, হেলালউদ্দিন আহমেদ, জাফর আহমেদ খান ও মুহিবুল হকের নামও।
আর চার নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য যাদের নাম আলোচনায় আছে তারা হলেন, সাবেক সচিব অপরুপ চৌধুরী, কামরুন নাহার, কানিজ ফাতেমা, কামালউদ্দীন তালুকদার, সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান, সাবেক সচিব মুশফিকা ইকফাত, অবসরপ্রাপ্ত সচিব মোঃ ফাইজুর রহমান, নারী নেত্রী রোকেয়া কবীর, ফেমার সাবেক সভাপতি মনিরা খান, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রাশিদা সুলতানা, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস এম আনোয়ারা বেগম, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সদস্য প্রফেসর ড. ফরিদা আবিদ খানম, বারডেম হাসপাতালের সাবেক মহাপরিচালক ডাঃ নাজমুন নাহার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফৌজিয়া মোসলেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাকিয়া পারভীন, অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন, সাংবাদিক অজয়দাশ গুপ্ত, নির্বাচন কমিশন থেকে সদ্য পদত্যাগকারী যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম ও সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার ও জেলা জজের নাম।
নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য ২৬ রাজনৈতিক দল, ছয় পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাব করা ৩২২ নামের মধ্য থেকে ১০ জনের তালিকা ঠিক করতে এ পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা বৈঠক করে সার্চ কমিটি। সুপ্রীমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত ২০ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে ১২- থেকে ১৩ জনের নাম ঠিক করা হয়। এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে প্রস্তাবিত ৩২২ নাম থেকে ২০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে সার্চ কমিটি। তার আগে বৈঠক হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। ওই বৈঠকে ৩২২ নাম নিয়ে পর্যালোচনা হয়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সুপ্রীমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বৈঠক করে সার্চ কমিটি। এর পর ৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় বৈঠক করে এ কমিটি। আর দ্বিতীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১২, ১৩ ও ১৬ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠনে বিশিষ্টজনদের মতামত নেয় সার্চ কমিটি। তবে ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠকের পর সার্চ কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যেও ২ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করে। ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠকে পাওয়া প্রস্তাব অনুসারে নির্বাচন কশিনের জন্য ২৬ রাজনৈতিক দল, ছয় পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাব করা ৩২২ জনের নামের তালিকা ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে সার্চ কমিটি। এতে অবসরপ্রাপ্ত প্রায় ১০০ জন সাবেক আমলা ছাড়াও বিচার বিভাগ, শিক্ষাবিদ, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম স্থান পায়।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলকে নাম জমা দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল সার্চ কমিটি। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায় থেকেও ই-মেইলে নাম পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়। এর পর প্রথমে আওয়ামী লীগসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ও ছয়টি পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে আরও অনেকে নাম প্রস্তাব করে। ১৫টি রাজনৈতিক দল নাম প্রস্তাব না করায় পরে আরও দুদিন সময় বাড়ানো হয়। পরে ওই ১৫টি দল থেকে আরও দুটি দল নাম জমা দিলেও বিএনপিসহ ১৩টি দল দেয়নি।
সার্চ কমিটিকে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা সুপারিশ করতে ১৫ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়। সে হিসাবে এ কমিটির হাতে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় থাকলেও ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করার জন্য ১০ নাম চূড়ান্ত করেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে দেরি হলেও এতে আইনগত কোন সমস্যা নেই।
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য নাম সুপারিশ করতে ৫ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ অনুসারে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ আপীল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে গেজেট প্রকাশ করে। সার্চ কমিটির অন্য পাঁচ সদস্য হলেন- হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন এবং কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক। সার্চ কমিটির কর্ম সম্পাদনে সাচিবিক সহায়তার দায়িত্ব দেয়া হয় মন্ত্রীপরিষদ সচিববকে।