বিএনপির ষড়যন্ত্রের চিঠি ফাঁস, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ছক

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কামনা করার মতো গুরুতর অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। ক্ষমতায় যেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে বিএনপি এমন অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গিয়ে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমের অস্তিত্বেই আঘাত করার ছক কষা হয়েছে। ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। যুক্তরাষ্ট্রে সাহায্য ও রফতানি বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য কামনা করেছে বিএনপি। সরকার দাবি করেছে, বিএনপির চিঠিকা- ষড়যন্ত্রের শামিল। দেশের বিরুদ্ধে বিদেশীদের কাছে চিঠি দিয়ে ষড়যন্ত্র করার বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেছে। এরপরই তদন্তে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে বাংলাদেশের সাহায্য ও রফতানি বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান সংবলিত চিঠি ফাঁস হয়ে গেছে। এখন সরকারের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেয়া বিএনপির সেই চিঠি। চিঠিকান্ডে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নিয়ে সরকারী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিকদের মধ্যে চলছে রাজনীতির বাহাস। দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যের সূত্র ধরে তদন্তে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
তদন্তে বের হয়ে এসেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্যবিষয়ক হাউস কমিটির চেয়ারম্যান ও বৈদেশিক প্রোগ্রাম বরাদ্দবিষয়ক সিনেট কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে ১৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে লেখা এবং বৈদেশিক সম্পর্ক-বিষয়ক সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান ও নিকটপূর্ব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া এবং কাউন্টার টেররিজম বিষয়ক সিনেট সাব-কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে ২৪ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে বিএনপির প্যাডে চিঠি লিখেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চিঠিতে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য দেয়াকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা অর্থাৎ প্রকারান্তে সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। লবিস্টদের সঙ্গে বিএনপির চুক্তিপত্রগুলো দেখিয়ে উল্লেখ করেন, ‘বিএনপি কয়েকটি চুক্তিতে তাদের কার্যালয়ের ঠিকানা ২৮ ভিআইপি রোড, নয়াপল্টন, ঢাকা, বাংলাদেশ দিয়েছে। তাদের পক্ষে আব্দুস সাত্তার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন এবং একই ধরনের চুক্তি তারা বিদেশের ঠিকানা দিয়ে করেছেন, সেখানে স্বাক্ষর করেছেন জিয়াউল ইসলাম।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুল সাহেব এই ডকুমেন্টগুলো কিভাবে অস্বীকার করবেন? দেশের বিরুদ্ধে তারা যে ষড়যন্ত্র করছেন, এগুলো হচ্ছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তথ্যপ্রমাণ হাজির করে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশকে সহায়তা পুনর্বিবেচনা ও বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের যে চিঠি দিয়েছিলেন তা এখন সরকারের হাতে রয়েছে। তিনি চিঠিগুলো উপস্থাপন করেন গণমাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লেখা চিঠিতে বিএনপি যেসব কথা লিখেছে, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলেও দাবি তথ্যমন্ত্রীর। ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিদেশীদের কাছে বিএনপির দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক চিঠি লেখার কারণে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে আত্মরক্ষার জন্য তারা প্রচন্ড মিথ্যাচার করছে। সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দফতরে পাঠানো বিএনপি মহাসচিব স্বাক্ষরিত চিঠিপত্র ও বিভিন্ন লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে বিএনপির ঢাকা অফিসের ঠিকানা সংবলিত চুক্তিনামা সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে সাহায্য বন্ধ করা, দেশের রফতানি বাণিজ্য বন্ধ করা, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, দেশকে বিদেশীদের কাছে বিব্রত করার জন্য বিদেশীদের কাছে বিএনপি যে চিঠি লিখেছে এবং লবিস্ট নিয়োগ করে, এ জন্য সুশীল সমাজসহ দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়েছে বিএনপি। ড. হাছান মাহমুদও স্বীকার করেছেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এসব বিষয়ে তদন্ত শুরু করছে।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, চিঠিগুলো কোন লবিস্ট নিয়োগের বিষয় নয়, মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি আহ্বান মাত্র। অর্থ সহায়তা বন্ধ করা আর অর্থ সহায়তা পর্যালোচনা করা কিন্তু এক কথা নয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার্থে সংবাদ সম্মেলন করে চিঠিকান্ডের সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে বিদেশীদের কাছে চিঠি লিখেছেন সেটি শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন। সাহায্য বন্ধ করার কথা অস্বীকার করলেও চিঠি দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সরকারের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব) এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে ১২ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চিঠি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধানের কাছে চিঠি প্রদানের ঘটনাটি থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনীতির বাহাসের উৎপত্তি। এরপর এই বাহাসের পালে হাওয়া লেগে তা বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ পর্যন্ত গড়ায়। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো এখন সব ছাপিয়ে বের হয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক মহলে বিএনপির মহাসচিবের দেয়া চিঠি। বাংলাদেশকে সহায়তা পুনর্বিবেচনা ও বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের যে চিঠি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকারের হাতে রয়েছে ওই চিঠি। চিঠিগুলো কি ষড়যন্ত্রমূলক? দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলার পর গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
কি লেখা হয়েছে চিঠিতে? মর্মার্থই বা কি? চিঠিতে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের পদক্ষেপের আহ্বান জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। যেহেতু বর্তমান ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকার একটি কর্তৃত্ববাদী, একদলীয় শাসনের পথে হাঁটার পরিকল্পনা করছে, আমরা সম্মানের সঙ্গে কংগ্রেসনাল এ্যাপ্রোপ্রিয়েটরদের বাংলাদেশে মার্কিন সহায়তা ও বৈদেশিক সহায়তা পর্যালোচনা করার জন্য তত্ত্বাবধান ক্ষমতা প্রয়োগ করার আহ্বান জানাই।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধের আহ্বান : এটা জরুরী যে কংগ্রেসনাল এ্যাপ্রোপ্রিয়েটররা সতর্কতার সঙ্গে ও কৌশলীভাবে এ পন্থা ব্যবহার করে আমেরিকার অত্যাবশ্যক জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ক্ষেত্রে এমনভাবে সুরক্ষিত করবেন, যা বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের কঠোর নেতৃত্বের অধীনে ক্রমাগত খারাপ হতে থাকা পরিস্থিতির উন্নতিতে অবদান রাখে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ।
চিঠিতে লেখা হয়, নির্বাচনের পর, দেশে গণতন্ত্রের অবনতি যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ ও এর প্রতি অসন্তোষ অব্যাহত রেখেছে। ইউএস এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চ, সশস্ত্রবাহিনী ও কংগ্রেস ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব ও মানবাধিকারের অপব্যবহারের বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে বাংলাদেশের ওপর ৫০ পৃষ্ঠার একটি কঠোর প্রতিবেদন রয়েছে। প্রতিবেদনে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ডিসেম্বরে এমন একটি একতরফা সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো পাঁচ বছরের মেয়াদে জয়লাভ করেছে যেটি অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না এবং যেখানে ব্যালট বাক্স ভর্তি, বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোর মতো বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ছিল।
আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সামনে সিনেটের সাক্ষ্যে ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান এ্যাডমিরাল ফিলিপ এস ডেভিডসন উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতা একত্রীকরণের প্রবণতার জানান দেয় এবং এতে আশঙ্কা জেগেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি একদলীয় রাষ্ট্র অর্জনের লক্ষ্যে রয়েছেন। পররাষ্ট্রবিষয়ক হাউস কমিটির পররাষ্ট্র সচিব পম্পেওকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের হুমকি মোকাবেলায় ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি দ্বিপক্ষীয় চিঠি পাঠিয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম সেই গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থগুলোকে গুরুতরভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে? বাহ্যিক চাপ সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার শাসনকে সুসংহত করতে এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও বিরোধী কণ্ঠস্বরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে চায় বলেও অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি চিঠিতে আরও লিখেছেন, অধিকন্তু চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা আরও খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। কারণ জাতিসংঘ সম্প্রতি শরণার্থীদের একটি উপকূলীয় দ্বীপে স্থানান্তর করার সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সতর্ক করেছে যে, সংশ্লিষ্ট উদ্বাস্তুদের সম্মতি ছাড়া অপরিকল্পিত স্থানান্তরে নতুন সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের সাহায্য ও রফতানি বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য চিঠি দেয়ার বিষয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে একজন মন্ত্রীর অভিযোগ করার বিষয়টি গুরুতর অভিযোগ হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করার জন্য তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে কারও বিরুদ্ধে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রচলিত আইনানুযায়ী শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার নিয়মনীতি রয়েছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।