মোঃ আবদুল হাছিব :
সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৫ সেপ্টেম্বর)। মরহুম এম সাইফুর রহমান কর্মময় জীবনে তাঁর অনন্য আন্তরিকতার গুণে নিজেকে সিলেট তথা সারা দেশের মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। মৌলভীবাজারের বাহারমর্দনের সন্তান এম সাইফুর রহমান দেশের অন্যতম অর্থমন্ত্রী, যিনি ১২ বার সংসদে বেশ সফলতার সঙ্গে বাজেট পেশ করেছেন। নিজ জন্মস্থান মৌলভীবাজারসহ পুরো সিলেট বিভাগেই তিনি ব্যাপক উন্নয়ন করেন।
১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর মৌলভীবাজারের বাহারমর্দনে জন্ম নেয়া এই খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ গ্রামের মক্তব ও পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৪০ সালে জগৎসী গোপালকৃষ্ণ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হন। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে আইকম পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে চলে যান। সেখানে পৌঁছার পর মত পাল্টে যায় তার ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন পরিবর্তন করে লেখাপড়া করেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টসে। ১৯৫৩-৫৮ সময়কালে পড়াশোনার পর ১৯৫৯ সালে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ফেলোশিপ অর্জন করেন। ১৯৬০ সালের ১৫ জুলাই বেগম দুররে সামাদ রহমানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। ২০০৩ সালে তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা যাওয়ার পথে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী গ্রামের বাড়ি বাহামর্দনে তাকে দাফন করা হয়।
এম. সাইফুর রহমানের জীবদ্দশায় দেখিয়ে গেছেন বড় মনের অনুপম দৃষ্টান্ত। যিনি নিজ হাতে মরহুম স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর নামে “হুমায়ুন রশীদ চত্বর” নাম করন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সিলেটের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আপোষহীন সাইফুর রহমান ছিলেন প্রচলিত রাজনীতিবিদদের চেয়ে ব্যাতিক্রম চরিত্রের।
মৃত্যুর একদিন আগেও তিনি বলেছিলেন “আমি সিলেটের মটি দেখে মরতে চাই” শীর্ষক সংবাদটি দেখে মনে হয়েছিল এম. সাইফুর রহমান যে কতটা সিলেট প্রেমিক ছিলেন। জীবনের শেষ জুম্মার নামাজ বন্দর বাজার মসজিদে আদায় করেছিলেন ও মসজিদের উন্নয়নে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “যত দিন বেঁচে থাকব সিলেটকে নিয়েই বাঁচতে চাই-সিলেটই আমার শেষ ঠিকানা”।
শতাব্দির শ্রেষ্ঠ সিলেট প্রেমিক, বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, উন্নয়নের বরপুত্র সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী “সিলেট বন্ধু” এম. সাইফুর রহমান। যাকে আজও খুঁজে বেড়ান বৃহত্তর সিলেটের মানুষ। সুনামগঞ্জের ভাটির জনপদ সেই তাহিরপুর ধর্মপাশা থেকে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ আজ ও খুঁজে বেড়ান তাদের প্রিয় নেতাকে।
সিলেট বিভাগের উন্নয়নের রূপকার, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১২ বার জাতীয় বাজেট পেশ করার গৌরব অর্জন করেন এম. সাইফুর রহমান। তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকে তলা বিহীন ঝুড়ি থেকে অর্থনীতির চাকাকে করেছিলেন সচল। তিনিই প্রথম বাংলাদেশে ভ্যাট প্রথা চালু করেন। এম. সাইফুর রহমানের পেশ করা সর্বশেষ বাজেটে বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে আনার যথা সাধ্য চেষ্টা চালান। তাই তো ঐ বাজেটে মাত্র ১২% বৈদেশিক সাহায্য আর ৮৮% দেশীয় বা অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহারের গুরুত্বারোপ করেন। আর এরই লক্ষ্যে বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে তার খোলামেলা কথা হত। তিনি স্বপ্ন দেখতেন- গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, বেকার সমস্যা দূর করন, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, মানব সম্পদকে দক্ষ করে গড়ে তোলা। তাঁর প্রবর্তিত অর্থনৈতিক সংস্কারের বিভিন্ন নীতিমালার কারণেই কৃষি, পোল্ট্রি, হ্যাচারী, দুগ্ধ ও গরু খামার যুব প্রশিক্ষণ সহ অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়।
এম সাইফুর রহমান সিলেট বিভাগ বাস্তবায়ন করেন ও সিলেট নগরীর আলমপুরে বিভাগীয় পর্যায়ের সকল অফিস স্থাপন করেন।
সিলেট নগরীর প্রবেশ পথে সুরমা পারে ছিলো অবৈধ দখলে আর পুরনো সার্কিট হাউস। সেগুলো সাইফুর রহমানের বদৌলতে পাল্টে গেছে সেখানকার পুরো দৃশ্য। ‘পুলের তল’ বলে যে স্থান সিলেটের মানুষের কাছে সবচেয়ে নিন্দিত ছিলো সেই পুলের তলে হয়েছে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের ভীড়। তাঁর ইচ্ছায় সুরমা নদীর উভয় তীরে টেমস নদীর তীরের মত প্রকল্পে ক্বীনব্রীজের নিচে দু’ধারে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে দৃষ্টিনন্দন স্পট গড়ে তোলা হয়েছে। ভিভিআইপি সার্কিট হাউস নির্মাণ, সংস্কারকৃত শারদা হল, ক্বীনব্রীজ ও আলী আমজাদের ঘড়ি, পাঠাগারের পাশে সুরমা নদীর তীর এখন সিলেটবাসীর জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান।
এছাড়া সিলেট নগরীর হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার সংস্কার, মানিক পীর (রহ.) মাজার সংস্কার, ভিভিআইপি সার্কিট হাউস থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি, সোডিয়াম বাতি, সিলেট-তামাবিল সড়ক নির্মাণ, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এর উন্নয়ন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, সিলেট ওসমানী বিমান বন্দর এর উন্নয়ন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা, সিলেট নতুন রেলওয়ে ষ্টেশন প্রতিষ্ঠা, এসএমপি প্রতিষ্ঠা, নতুন ফায়ার স্টেশন স্থাপন, টিএন্ডটির নতুন এক্সচেঞ্জ স্থাপন, হার্ট ফাউন্ডেশনের উন্নয়ন, আলমপুরে নগরবাসীর জন্য পার্ক, কদমতলী পয়েন্টের জায়গা কে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান জানিয়ে মুক্তযোদ্ধা স্কয়ার প্রতিষ্টা, ডায়াবেটিকস হাসপাতালে অনুদান, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী,শিল্পকলা একাডেমী, মডেল স্কুল উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষার প্রসারে তাঁর আন্তরিকতার কারণে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে এম সাইফুর কলেজ প্রতিষ্ঠা, সরকারী মহিলা কলেজ ছাত্রী নিবাস ও নতুন ভবন, শাহী ঈদগাহে স্বাস্থ্য সেবা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, সিলেট নগরীর আলমপুরে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পুরুষ ও মহিলা, আলমপুরে ফায়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, বিআরটিএর ট্রেনিং সেন্টার ও বিভাগীয় অফিস স্থাপন, সিলেট শিক্ষা বোর্ড, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হোস্টেল নির্মাণ, বিকেএসপির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা, সিলেট স্টেডিয়ামের উন্নয়ন ও ফ্লাড লাইট স্থাপন, শাহপরান ব্রীজ, তৃতীয় শাহজালাল সেতু, কাজিরবাজারে সুরমা সেতুর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন, সিলেট কোর্টে বিল্ডিং নির্মাণ,মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল এর উন্নয়ন, দক্ষিণ সুরমা ট্রাক টার্মিনাল, দক্ষিণ সুরমা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের পরিকল্পনা গ্রহণ ছিলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সিলেট নগরী সহ পুরো সিলেট জেলার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন। ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহ এর উন্নয়ন, বিভিন্ন, মসজিদ, আলীয়া মাদ্রাসা সহ অসংখ্য মাদ্রাসা, মন্দির, গীর্জার ও উন্নয়ন করেছেন।
এছাড়া সিলেট প্রেসক্লাব ভবন নির্মাণ সহ সিলেটের অধিকাংশ উন্নয়ন এর মাঝে অম্লান হয়ে আছেন এম. সাইফুর রহমান। সিলেটপ্রেমী এম সাইফুর রহমান তাঁর কর্মের মাঝে সিলেটবাসীর হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে থাকবেন।