মন্ত্রী সভায় খসড়া অনুমোদন ॥ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে নতুন আইন হচ্ছে ॥ এ আইনে সাংবাদিকতার কণ্ঠ বোধ করার বিষয় থাকবে না-তথ্যমন্ত্রী ॥ সাংবাদিকরাও ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন- সুলতানা কামাল

47

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে একটি নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার। গত ২৯ জানুয়ারি এই আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। সংসদে উত্থাপন শেষে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বর্তমানে খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে রয়েছে। আজ এই কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন পেলে খসড়াটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপিত হবে। সংসদে পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর শেষে এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে।
এর আগে গত জানুয়ারিতে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার পর এটি ঘিরে বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়। সংসদে উত্থাপনের পর বেশকিছু ধারা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে। এসব ধারার অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। এই আইনের সুযোগে ভবিষ্যতে হয়রানির আশঙ্কাও করছেন অনেকে। সমালোচনা তৈরি হয়েছে আইনের নানাদিক নিয়ে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইনটিতে আগের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ধারাগুলোই ভিন্ন আঙ্গিকে রয়েছে। এর অনেক ধারার হয়রানি আর অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে।
সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছয়টি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। সংগঠনটির সদস্যরা বলছেন, এই ধারাগুলো বাকস্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এ জন্য তারা এ ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। ধারাগুলো হলো ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ নম্বর। এর আগে মার্চে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারা (২১, ২৫, ২৮ এবং ৩২ নম্বর) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ১০ দেশের কূটনীতিক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দেশগুলো হলো—জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাজ্য, স্পেন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ (ডিএসএ)-এ এমন কিছু ধারা রয়েছে, যা সংবিধানে থাকা মতপ্রকাশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে রাষ্ট্র বা ব্যক্তিবিশেষ স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে খসড়ায় সন্নিবিষ্ট কিছু অস্পষ্ট শব্দ ও সুনির্দিষ্ট কিছু ধারা জনকল্যাণসহ ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের মাধ্যম সুবিবেচনাসম্পন্ন নিরীহ ব্যক্তিরাও হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও কারাদন্ডের মুখে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে দেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন বলেন, সরকারের উচিত ছিল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে আইনটি করা। এখনো সুযোগ আছে। সবার মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে আইনটি সংসদে পাস করলে ভালো হয়। আর এই পুনর্বিবেচনার উদ্যোগটি সরকারকেই নিতে হবে।
প্রস্তাবিত আইনটি সংশোধন হওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামালও। তিনি বলেন, এই আইনের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সাংবাদিকরাও ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। মানুষের তথ্য জানার অধিকার বিঘিœত হবে। এমন আইন করা উচিত, যা উভয় পক্ষকে নিরাপত্তা দেবে। অবশ্যই অংশীজনের মতামত নিয়ে সংশোধন করতে হবে। নতুবা ৫৭ ধারার মতো এই আইনেরও অপব্যবহার হবে।
অবশ্য সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শুরু থেকেই বলে আসছেন, এটা ফ্রিডম অব প্রেস বা ফ্রিডম অব স্পিচ বন্ধ করার জন্য নয়। সেই ক্ষেত্রে আইনে যদি কোনো ত্রুটি বা দুর্বলতা থাকে, তাহলে সেগুলো সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করা হবে। আশা করছি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহলের যে উদ্বেগ তা দূর করা যাবে।
গতকালও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ডিজিটাল সাইবার অপরাধীদের আটকাতেই এই আইন হচ্ছে। ডিজিটাল জগৎকে মোকাবিলা করতে এই আইন করা হচ্ছে। সেখানে সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার মতো বিষয় যাতে না থাকে, সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে। সংবিধানে গণমাধ্যমে যে স্বাধীনতা আছে, সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করেই আইন করতে হবে।
এ ব্যাপারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সাইবার অপরাধ ঠেকাতে এই আইন; কারো বাকস্বাধীনতা রোধ করতে নয়। আশা করছি আগামী অধিবেশনে এই আইনটি পাস হবে। এই আইনের ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হবে। মন্ত্রী আরো বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তার কারণে ফরেনসিক ল্যাব তৈরি হয়েছে, যা আগামীতে আরো বৃদ্ধি করা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়ে দেশের পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যাদের এই সংক্রান্ত প্রযুক্তি রয়েছে তাদের আরো আপগ্রেড প্রযুক্তি দিয়ে শক্তিশালী করা হবে।
গণমাধ্যম ও আইন বিশেষজ্ঞরা নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তত সাতটি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এগুলো হলো—৪, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩২ নম্বর ধারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক উঠেছে আইনের ৩২ ধারা নিয়ে। এই ধারা স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বাধা হবে বলে মনে করছেন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ। এই ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। আবার এই অপরাধ অজামিনযোগ্য। এই ধারাটি নিয়েই সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে।
২৯ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানি-সংক্রান্ত দন্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। আবার অপরাধটি দ্বিতীয় বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।
আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালানো বা তাতে মদদ দেন, তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের শাস্তি ১৪ বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড। আর বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তা হবে একটি অপরাধ। এজন্য তিনি সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এই ধারার অপরাধে জামিন হবে না।
৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ বাংলাদেশের বাইরে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেন, যা বাংলাদেশে সংঘটন করলে এই আইনের অধীনে দণ্ডযোগ্য হতো, তাহলে এই আইনের বিধানাবলি এইভাবে প্রযোজ্য হবে, যেন ওই অপরাধ তিনি বাংলাদেশেই সংঘটন করেছেন।
২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য প্রেরণ করেন, ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে—এমন তথ্য প্রকাশ করেন, মিথ্যা জানা থাকার পর কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, তাহলে এটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ অপরাধের শাস্তি হবে তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দান। এসব অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ করে, তাহলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড একসঙ্গে দেওয়া হবে।