কাজিরকাজার ডেস্ক :
রিফাত। একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মী। স্বামী-শাশুড়ির সঙ্গে সুখের সংসার। এরই মধ্যে আবার সুখবর। করোনাকালে বিষণ্ন সময়ে আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছিল খবরটি। প্রথমে ঘরোয়া পদ্ধতিতে নিশ্চিত হলেও পরিচিত এক ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে কয়েকটি পরীক্ষা করান রাজধানীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে। করোনাকালে কোন গাইনোকোলজিস্ট চেম্বার না করার কারণেই বাধে বিপত্তি। পরীক্ষা তো করিয়েছেন। কিন্তু রিপোর্টগুলো কাকে দেখাবেন এবার? ওই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে তাকে রিপোর্টগুলোর ছবি তুলে পাঠান হোয়াটসএ্যাপে। সেগুলো দেখে ডাক্তার জানান, রিফাত ৬ সপ্তাহের গর্ভবতী। নানা টানাপোড়েনের ঘরটিতে বয়ে যায় খুশির বন্যা। টেলিফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ডাক্তারের সঙ্গে চলছিল নিয়মিত কথা। ভালই চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে হঠাৎ রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ায়। তাৎক্ষণিকভাবে কোন চিকিৎসকের অধীনে হাসপাতালে ভর্তি জরুরী হলেও রাজধানীর প্রায় সব বড় সরকারী হাসপাতালেই করোনা রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে। বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ থাকলেও সীমিত সাধ্যে সাহসে কুলায় না। একদিন এভাবে ঘরেই চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিলেও পরের দিন শরীর খারাপ হয়ে যায় মারাত্মকভাবে। বাসায় রাখা বিপজ্জনক মনে করে স্বামী রিমন তাকে নিয়ে যান প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করাতে না পেরে নিয়ে আসেন বেসরকারী হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। সেখানেও গাইনি ডাক্তার না থাকায় নিয়ে যাওয়া হয় আদ-দ্বীন হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে কাহিল রিফাত। চিকিৎসা শুরু করার আগেই ডাক্তার জানালো চরম দুঃসংবাদটি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর অক্সিজেনের অভাবে রিফাতের গর্ভের শিশুটি মারা গেছে। রিফাতকেও বাঁচানো যাবে কিনা বলা যাচ্ছে না। চিকিৎসকরা সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একদিন পরেই মারা গেল রিফাতও। সঠিক সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলে রিফাত এবং তার অনাগত সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারত বলে আহাজারি করছেন স্বামী রিমন।
একেবারে শেষ সময়ে রিফাতকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো গেলেও প্রসব বেদনায় কাতর জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা দেলোয়ারা বেগম তানিয়াকে কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারছেন না তার স্বজনরা। গর্ভের পূর্ণ সময়েই প্রসব বেদনা উঠলেও তানিয়া যে কোভিড-১৯ পজিটিভ। এই অবস্থায় তার ডেলিভারি কোন হাসপাতালে করাতে পারবেন তা জানেন না তার স্বজনরা। হন্যে হয়ে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত খালাত বোন তাহমিনা ইসলাম তালুকদার বলেন, দুলাভাইও করোনা পজিটিভ। একে তো আপার প্রসব বেদনা তার ওপর করোনার সংক্রমণ। আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে চেষ্টা করছি ভর্তি করানোর জন্য কিন্তু কোথাও থেকে ইতিবাচক ফল পাচ্ছি না। আল্লাহই জানেন আপা আর তার অনাগত শিশু সন্তানের কপালে কি আছে!
শুধু রিফাত বা তানিয়া নন কোভিড-১৯ এর মহামারী সময়ে দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালেই চলছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা। ফলে গর্ভধারণ করলেও সংক্রমণের ভয়ে হাসপাতালে যেতে পারছেন না সন্তানসম্ভবা মায়েরা। এতে কোন কোন ক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর যেমন শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম হচ্ছে তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে মা ও শিশুর মৃত্যুর মতো ঘটনাও।
স্বাস্থ্য অধিদফতরও স্বীকার করছে, করোনাকালে সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানে প্রসবপূর্ব সেবা আগের বছরের তুলনায় কম নিয়েছেন মায়েরা। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রসবপূর্ব ন্যূনতম চারবার সেবা নেয়ার হার এক-চতুর্থাংশ কম ছিল। এ সময়ে মামৃত্যু বেড়েছে ১৭ শতাংশ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১৯ সালে ৯৬৭ জন এবং ২০২০ সালে ১ হাজার ১৩৩ জন মায়ের প্রসবকালীন মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৮২ জন মায়ের। গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাতৃমৃত্যুর যত ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এপ্রিলে মারা গেছেন ২২৮ জন। একই সময়ে প্রসবপূর্ব প্রথমবার সেবা নিতে যাওয়া মায়েদের হার ২৬ শতাংশ কম ছিল। দ্বিতীয়বার ২৫ শতাংশ, তৃতীয়বার ২৬ শতাংশ এবং চতুর্থবার ছিল ২৪ শতাংশ কম।
করোনাকালে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসার জন্য আলাদা বিভাগ চালু আছে জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ উম্মে হানি মিতা বলেন, আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি সবাই মিলে। পুরো বিশ্বই করোনার মহামারীতে বিপর্যস্ত। এ অবস্থা নিশ্চয়ই একটা সময় কাটিয়ে উঠবে পৃথিবী। কিন্তু আজকে যে সন্তান জন্ম নেবে সেই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তার ভবিষ্যত সুন্দর করতে গর্ভবতী মায়েদের একটু কষ্ট হলেও হাসপাতালে আসতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে একটি সুস্থ সবল শিশুর জন্ম হলেই আমাদের আগামীর পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যালের গাইনি বিভাগ ‘ওভারলোডেড’। এদের মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ যেমন আছে নেগটিভ রোগীও আছে। আমরা যেমনটা জানি করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড অন্যান্য হাসপাতালে সার্জারির অপশন নাই। যেটা ঢাকা মেডিক্যাল বা মুগদায় রয়েছে। তবে মুগদার চাইতে ঢাকা মেডিক্যালেই চাপটা বেশি। প্রতিদিন ৮০ জন থেকে ৯০ জন ভর্তি হচ্ছেন। তারপরও রয়েছে আইসিইউ সঙ্কট। এসব কাটিয়ে উঠা সত্যিই একটু কঠিন।
বিশেষজ্ঞরাও বারবার আশঙ্কা করেছিলেন প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসায় করোনার মারাত্মক প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞ গাইনি চিকিৎসক ডাঃ শিখা গাঙ্গুলি বলেন, একজন মায়ের গর্ভধারণের পর সন্তান প্রসব পর্যন্ত অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা আছে আটবার। এই চারবার সেবা নেয়ার হার আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে এক-চতুর্থাংশ কম ছিল। সংখ্যা হিসাবে ধরলে এক থেকে আড়াই লাখ। বিশেষ করে, গর্ভধারণের পর প্রথম দফায় সেবা নেয়াটা সবচেয়ে জরুরী। চিকিৎসকেরা মাকে তখন পুরো গর্ভকালের একটি পরিকল্পনা দেন। তবে স্বাভাবিক সময়েও মায়েরা চারবার আসতে চান না। তাদের বেশিরভাগই কোন জটিল সমস্যা তৈরি না হলে আসেন না। অন্তত চারবার সেবা নেয়ার গুরুত্বটা তাদের বোঝানো যায় না। আর করোনাকালে তো কেউ সংক্রমণের ভয়ে আসেন নি হাসপাতালে। তাহলে তো মা ও নবজাতকের শরীরে জটিলতা তৈরি হবেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, গত দেড় বছরের মধ্যে গত এপ্রিলে মাতৃমৃত্যু সবচেয়ে বেশি। গত বছরের কঠিন সময়েও মাতৃমৃত্যু ছিল মাসে এর এক-তৃতীয়াংশ। এখন কেন মায়েরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক সহকারী পরিচালক এবং বর্তমানে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তার বলেন, করোনাকালে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য স্পষ্ট কিছু গাইডলাইন দেয়া আছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে গর্ভবতী মায়েদের জন্য রয়েছে আলাদা সেবা কেন্দ্র। এখন যদি মায়েরা চিকিৎসা নিতে না আসেন তাহলে কিভাবে হবে? একজন মা ও তার সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিতে চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা যেন করোনায় সংক্রমিত না হন সেটাও দেখা জরুরী। তাই সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে গর্ভের শুরু থেকেই যেকোন হাসপাতালে চিকিৎসকের নিয়মিত তদারকিতে থাকতে হবে মাকে। পরিবারকেও এজন্য নিতে হবে সচেতনতামূলক ব্যবস্থা।
এ ব্যাপারে বারডেম হাসপাতালের প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এবং অবসটেট্রিক্যাল এ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ ফেরদৌসী বেগম এক সাক্ষাতকারে বলেন, ৩৫ বছর ধরে এ খাতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আগে কী পরিমাণ মাতৃমৃত্যু হতো। ২০০১ থেকে ২০১০ সালে মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৩২২ থেকে ১৯৪-এ নেমে আসে। এটা অনেক বড় অর্জন। যদিও মাতৃমৃত্যু ২০-এ নামিয়ে আনতে হবে। জরিপগুলো করার সময় একই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান অনুসরণ করে কাজ করা হয়। ২০১৬ সালের জরিপের জন্য হিসাব নেয়া হয়েছিল ২০১৪-১৫ সালের। ২০১৬-১৭ সালের হিসাব নিয়ে করলে মাতৃমৃত্যু কম হবে বলেই মনে করি। ২০০১ সালে যখন মাতৃমৃত্যুর জরিপ অনুসরণ করা হয়েছিল, তখন তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করে তিন ধরনের ফল পাওয়া গিয়েছিল। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, আমাদের মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৭০-এ নামিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে করোনাভাইরাস একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, দেশে বছরে গড়ে ২২ লাখ প্রসবের ঘটনা ঘটে। বাড়িতেই এর অর্ধেক। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, বাকি অর্ধেক বিভিন্ন সেবা কেন্দ্রে। এর ১৫ শতাংশ সরকারী প্রতিষ্ঠানে, ৮৫ শতাংশ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে হয়।