মাদকের ভয়াল ছোবল, কারণ ও প্রতিকার

12

ইমতিয়াজ রহমান ইনু :

আজ আন্তর্জাতিক মাদক প্রতিরোধ দিবস ২৬ শে জুন মাদকের ভয়বহতার কথা ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার কারও কাছে অজানা নেই মাদকের কথা আমাদের তরুণ প্রজন্মের চার কোটির মধ্যে এক কোটি আজ মাদকের অন্ধকার ছোবলে আক্রান্ত। বলতে এত যে কষ্টকর-মাদক আমদের সমাজে ও পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতি চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। যা বলার কোনো ভাষা নেই। এই ব্যর্থতা কার? এরা সবাই আমাদের সমাজের আমার আপনার প্রতিবেশী, ভাই ভাতিজা, কোনো না কোনো মা বাবার সন্তান।
বাংলাদেশ সরকার মাদকের অপপ্রয়োগ রোধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী আন্দোলন সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৩৬ সালে বিপজ্জনক মাদক দ্রব্যের অবৈধ পাচার রোধ সংক্রান্ত কনভেনশন প্রণীত হয়। এ কনভেনশনের আওতায় তৎকালীন লীগ অব নেশনস এবং পরবর্তীকালে জাতিসংঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে কোন রাষ্ট্রই আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে মাদকের অবৈধ পাচারকারীদের শাস্তিদান এড়িয়ে যেতে না পারে। বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে ১৯৬১ সালের মাদকদ্রব্যের উপর একক কনভেনশনে অংশীদারিত্ব লাভ করে এবং চেতননাশক দ্রব্য কনভেনশন ১৯৭১; মাদকদ্রব্য ও চেতনানাশক দ্রব্যের অবৈধ পাচার রোধে জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৮৮ এবং সার্ক কনভেনশন ১৯৯০ তে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ২৬ জুন পালন করে।
দিন তারিখটা মনে নেই, শিশির বেলা ১০ঘটিকায় আমি আমার ব্যক্তিগত কাজের জন্য অপেক্ষায় আমার এক বন্ধুর জন্য সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজারে তরুণ প্রজন্ম মাদকাসক্ত সন্তানের জন্য মায়ের আকুতি। রাতে বাসায় ফিরেনি মাদকাসক্ত সন্তান। সারারাত মা সন্তানের জন্য বাসায় হতাশায় অপেক্ষায় কি না কি হলো সন্তানের। সকাল বেলা মা সন্তান খুঁজে বাহির হলে দেখতে পান, মাদকাসক্ত সন্তান মাদক সঙ্গী সাথি নিয়ে রাতে ফুটপাতে রাত কাটিয়েছে। মা সন্তানকে পেয়ে গেলেন। সন্তান তো নেশায় ঘরে মাতাল হয়ে আছে। মা কান্নার শোরে জড়িয়ে ধরলেন সন্তানকে। খুব চেষ্টা করছেন বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। রিক্সা তুলতে লাগলেন সন্তানকে, কিন্তু পারছেন না মা। রিক্সা তুলতে দুঃখের কথা আশেপাশে এত মানুষ থাকতে সহযোগীতার হাত বাড়ালেন না কেউ। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন আজ যারা দেখে সহযোগিতা করেননি তাদের যদি ভাই-ভাতিজা হতো এভাবে তারা কি এড়িয়ে যেতেন? আমি ঐ মাকে বললাম- আপনি সরেন, আমি রিক্সা ড্রাইভার ভাইকে নিয়ে সন্তান রিক্সায় তুললাম। নেশায় মাতালের কারনে রিক্সা থেকে পড়ে যাচ্ছে মাদকাসক্ত সন্তানটা। সন্তানকে বললাম, রিক্সা থেকে পড়ে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। আপনি সিএনজি গাড়িতে তুলে নেন। তারপরে সিএনজিতে করে সন্তানকে বাসায় নিয়ে গেলেন। প্রতিদিন শহরের বন্দর বাজারে সবার চোখের সামনে পরে কত মাদকাসক্ত তা অবিশ^াস করার কিছু নেই। প্রতিনিয়ত পত্রিকার খুললেই দেখা যায় নেশা টাকার জন্য মাদকাসক্ত তরুণ ও তরুণীদের কাছে পিতা মাতা পাড়া প্রতিবেশী কতজন খুন হয়। আরও কত কষ্টকর ঘটনা ঘটায়। বহু প্রতিভা অকালে ঝড়ে পড়ছে মাদেকর ভয়াবহ তাবায়
‘জেলখানা থেকে মাদকাসক্ত সন্তানের চিঠি’ আব্বু, তোমরা কেমন আছো? কতদিন তোমাদের দেখি না? তোমাদের দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কোন চিঠি লিখেলেও তোমাদের উত্তর পাই না। অনেকদিন তুমরা কেউ আমাদের দেখতে আসে না। কোন চিঠিও লিখো না। আমিতো এখনো বেচে আছি আব্বু। কিভাবে নিজের সন্তানকে ভূলে গেলে তোমরা। আব্বু আমার জীবনটা কি আমার একা ভূলের জন্য নষ্ট হয়ে গেল? তোমরা কেবল তোমাদের হিসাব দেখলে তুমি বারবার বল আমার চিকিৎসা আর আইন আদালত দৌড়াতে দৌড়াতে তুমি সর্বশান্ত হয়ে গেছো। এক চাকরী জীবনে তুমি নানা ভাবে বিত্তের পাহাড় গড়া নেশাগ্রস্ত ছিলে-চিত্তের মাঝে তুমার ছিলো না। আমাদের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা। এসব নিয়ে আম্মুর মনেও কষ্টের কমতি ছিলোনা আর তুমি বলেছ আম্মু আমার কষ্টেই অকালে মারা গেছে। কিন্তু কিভাবে আমি মাদকাসক্ত হলাম তা কখনো ভেবে দেখোনি তুমি? তুমাদের উদাসীতায় আর অবহেলায় পাহাড় না থাকলে আমার এই পরিণতি হতো না। ভাইয়া অষ্ট্রেলিয়ার পড়তে গিয়ে ওখানে সেটেলড হলো। তার জন্য তুমারা সব করলে আমাদের বুয়েটে ভর্তির পরই টিউশনী ধরতে হল। এমন হিসাব করে টাকা দিতে যে খরছ বেড়ে যাওয়ায় বাসা থেকে এটা সেটা সরিয়ে এনে বিক্রি করতে শুরু করি। নানারকমের সিগারেটের নেশাটা প্রবল মাদকাসক্ততিতে রূপ নিলে ক্লাস, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। যেদিন প্রথম নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলে সেদিন বাসার সবাই মিলে এসন মানসিক নির্যাতন করলে যে সহ্য করতে না পেরে তাতেই বাড়ি ছাড়লাম। তারপর কেবলই অঘটন আমার আর সংসারে ফেরা হলো না। ফেরা হলো না জীবনে। আব্বু, বৃষ্টি আমার আদরের ছোট বোন। ওর বিয়ে দিলে, আমাকে খবরটাও জানালে না। কথাটা মনে হলে আমার কান্না পায়। আব্বু তুমি জান, আম্মার অলংকারে বক্সটা আমি সরিয়েছিলাম। সেজন্য তুমি নাকি দিব্যি দিয়েছিলে আমি মরলেও তুমি ফিরে থাকাবে না। আমি মরণ নেশায় আসক্ত হয়েছি। নেশায় আমার সব বিচার বুদ্ধি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। মাদকাসক্তি থেকে কখন যে ড্রাগ ট্রেডিং এ জড়িয়ে পড়লাম। একদিন ধরা পড়ে গেলাম। ট্রেন থেকে নামার পড় ষ্টেশনের পুলিশ ব্যগ দেখতে চাইলে আমি ব্যাগের চেইন খুলে দিয়ে পেছনে চেয়ে দেখি ওরা কেউ নেই। তারপর দেড় মাসে বিচার শেষে আমার সাত বছর জেলা হল আব্বু তুমি ভালো আইজীবী দিয়ে চেষ্টা করলে এত বড় শাস্তি আমার হয়তো বা হতো না। কিন্তু তুমি চাওনি কুলাঙ্গার সন্তান তুমার সংসারে ফিরে আসুক। আব্বু, কি অবাক এই পৃথিবী সন্তান নষ্ট হয়ে গেলে মা বাবা ¯েœহ মমতা শুকিয়ে যায়। আব্বু, কাল সারারাত আমি কেঁদেছি আমাদের সেলে গতকাল সন্ধ্যায় এক নতুন কয়েদী এসে বলে ‘চাইর নম্বর খুন করে আইলাম’। রাতে ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে তার শরীরের পা টিপিয়েছে। আমার শব্দ করতে কাদতে দেয়নি। এরকম বেচে থাকার চেয়েও মরে যাওয়া অনেক ভালো। আব্বু, আমি আর বাঁচতে চাইনা। আমি মরে যাবো। আমি মরে গেলে আব্বু, আমার মরা লাশটা তোমরা নিতে আসবে তো? ইতি তোমার হতভাগা সন্তান বিপু।
আজকের তরুণ যুব সমাজ পথশিশু হিরোইন, ইয়াবা, পেথেডিন, ফেনসিডিল, গাজা, মদ, আফিম, কোকেন, গুমের ঔষধ, ডেন্ডি ইত্যাদি কত ধরনের নেশায় আসক্ত। শিকড় যেমন মাটিকে আটকে ধরে রাখে তেমনী নেশার জগতে যে একবার পা দিয়েছে তার ফিরে আসা খুবই কঠিন। বহুবিধ কারনে মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। মাদক সেবনকারীর বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়-কৌতুহলে খারাপ বন্ধুবান্ধদের সাথে চলাফেরায় প্রেম ভালোবাসার ব্যর্থতায় মানসিক অশান্তির কারণে পারিবারিক অশান্তির বেকারত্বের, যৌন আকাক্সক্ষার, বিনা অপরাধে সমাজে অপরাধি সাজানোর কারনে, বেশী আনন্দ উপভোগের কারনে, অসৎ রাজনীতিকের আড্ডায় মাদকাসক্ত দিনে দিনে বাড়ছে। একজন গবেষক বলেছিলেন, বিষ একজনকে ধ্বংস করে আর মাদক পুড়া জাতিকে ধ্বংস করে একজন মাদকাসক্ত আক্রান্ত ছোবলে শুধু মাদকাসক্তরা নয় পুরো সমাজের ক্ষতি হয়। পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করে। বাসায় দামিদামি জিনিষ বিক্রি করে নেশার টাকার জন্য। আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার ও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে টাকা নেয় নেশার জন্য। পরিবারকে সমাজের কাছে ছোট রাখে। বারবার জেল হাজতে যাওয়ার প্রবণতা। যখন নেশার টাকা জোগান দিতে পারে না, তখন সমাজে চুরি, চিনতাই, খুন, খারাপি বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের দেখাদেখী সমাজে অন্য সন্তানরা মাদকাসক্ত হয়। শারিরীক বিভিন্ন রোগে সে আক্রান্ত হয় নেশার টাকার জন্য নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করে। এইচআইভি, এইডস, যৌনরোগ, শ^াসতন্ত্র, হেপাটাইটিস ভি, মস্তিস্কের কর্মক্ষমতার লোভ অস্থিরতা উত্তেজনা অনিন্দা সৃষ্টি করে, এমনকি মৃত্যু এর অনিবার্য পরিণতি। মাদকাসক্তির লক্ষণ ও চেনার উপায়- যখন কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তখন তার মধ্যে কিছু কিছু লক্ষণ ও চিত্র পরিলক্ষিত হয় যেমন- সাম্প্রতিক আচরণে পরিবর্তন, টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়া, রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া, বসে জিমায়, ঘুম ঘুম ভাব, মিথ্যা কথা বলা, নতুন নতুন বন্ধুবান্ধবের সাথে চলাফেরা, আত্মীয়স্বজন থেকে দুরে থাকা, অপরাধের কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর, খাবার গ্রহণে অনিহা, মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের প্রতি আগ্রহ থাকা, মানষিক খুব অস্থিরতা, নেশা না নেওয়ায় অসুস্থতা, মানষিকতা কখনো খুব ভালো কখনোও খুব মন্দ আচরণ, কখনো চুপচাপ, কখনো খুব বেশী কথা বলে বিরক্তকর। আমাদের দেশে কেন মাদকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের চারপাশে রয়েছে বর্ডার এলাকা। অনেক সময় দেখা যায় কালো পাচারকারীরা বাইপাশ রাস্তা হিসেবে আমাদের দেশে রাস্তা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে মাদক পাচার করে কৌশলে। তেমনী সচেতনতার অভাব। বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা আড়ালে থাকে, সহজে মাদক ব্যবসায়ী জামিন পাওয়ায় বার বার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। নতুন কৌশলে মাদক পাচার করে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে জনগণের সহযোগীতা কম, প্রতিহিংসা রাজনৈতিক বেকারত্বের হার বেশি। কর্মক্ষমতা কম, মাদকাসক্তরা সুস্থ হওয়ার জন্য কাউন্সেলিং ও সরকারী মাদক নিরাময় পূর্ণবাসন চিকিৎসা কেন্দ্র নাই বললেই চলে। সুস্থ হয়ে কর্মস্থান না পাওয়ায় সহজে মাদক পাওয়ায় সমাজের ভালো সহযোগীতা না থাকায় মাদক প্রতিরোধে সরকার ও সমাজের নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। মাদক সম্পর্কে সচেতন থাকা পরিবারের ছেলেমেয়ের প্রতি ভালো আচরণ বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব থাকতে হবে। প্রতিটি পাড়া ক্লাব, সমিতি, সংস্থা প্রতিনিয়ত মাদক সচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। স্কুল-কলেজ, মাদরাসায় মাদকের কুফল সম্পর্কে পাঠদান চালু করা। মসজিদ, মন্দির, গির্জায় মাদকের কুফল সম্পর্কে আলোচনা ও ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা প্রচার করা, আইনের কঠোর প্রয়োগ করা, জনগন ও প্রশাসনের সহজে সহযোগীতা একে অপরের মধ্যে তৈরী প্রামাণ্য তথ্যচিত্র। মাদক স্পট চিহ্নিত করে প্রশাসনের নজর বাড়াতে হবে। প্রতিনিয়ত পত্রিকায় টিভি, চ্যানেল, রেডিও প্রচার করতে হবে। মাদকাসক্তদের মাদক পূর্ববাস চিকিৎসা কাউন্সেলিং করে দক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ জীবনে ফিরিয়ে আনা, এতেই কমবে মাদকাসক্ত। যুব সমাজ বেঁচে যাবে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে।