অবক্ষয়ের অপর নাম মোবাইল

22

বিশ্বজিত রায়

কতটা নিরাপদে আছে আমাদের সন্তান? নিজের ভাবনায় ঘুরপাক খায় এমন প্রশ্ন। আবার ভাবুক মনে এও খেলা করে- আমরা নিজেরাই নিজের সন্তানকে বিপদে ঠেলে দিচ্ছি কি না। চিন্তক মনের এ ভাবনাটুকু কারও কাছে অবান্তর মনে হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ যারা ভাবনার ভাষাগুলোকে অবান্তর হিসেবে বিবেচনা করবেন, তারা উল্টো প্রশ্ন রেখে বলতে পারেন- কেউ কি কারও সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় নাকি, এটা আহাম্মকি কথাবার্তা। তাহলে পুরো বিষয়টা এবার বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন।
নাম তার মোবাইল। একটু স্মার্টনেসলি বলতে গেলে নামটা হবে এ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বাক্সবন্দী রসদ রক্ষিত আছে তাতে। সেটা আমরা সর্বদা পকেটে নিয়েই ঘুরছি। অতি সহজেই তা অবুঝ সন্তানের হাতেও তুলে দিচ্ছি। শুধু শিশুরাই নয়, কিশোরবয়সী উন্মত্ত তরুণ-তরুণী এতে হাত বুলিয়ে নিজেরা নষ্টামীর দূষিত জলে ঝাঁপ দিচ্ছে। কি নেই প্রযুক্তির আশীর্বাদতুল্য এই বস্তুটিতে। ফেসবুক, হোয়াটস এ্যাপ, ইমু, ইউটিউব, গুগলসহ অসম্ভব আকর্ষণীয় সব এ্যাপ। যে এ্যাপে যুক্ত হয়ে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে যৌন উত্তেজক রগরগে যত দৃশ্যপট। একটিতে প্রবেশ করলে আরেকটি আহ্বান করছে তাতে যুক্ত হওয়ার। যারা সদ্যযৌবনা তারা আগ্রহভরে এতে চোখ বুলাচ্ছে, আর অজানাবশত এসব দেখে যৌবন দূরবর্তী অবুঝ শিশুরা খোদ মা-বাবাকেই অস্বস্থিকর প্রশ্ন করে বসছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি সংবাদে আমার দৃষ্টিগোচর হয়। সে সংবাদে ইন্টারনেট সমৃদ্ধ মোবাইল কিভাবে শিশু-কিশোরদের বিপথগামী করছে তা প্রকাশ করা হয়েছে। খবরে জানা যায়, ইউটিউবে জনপ্রিয় সিরিজ মি. বিন দেখছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী সোমা। এ সময় সে লক্ষ্য করল ‘লনলি ওয়াইফ’ নামের একটি ভিডিও সাজেস্ট করা হচ্ছে তাকে। মাকে প্রশ্ন করল মেয়ে- আম্মু, ‘লনলি ওয়াইফ মানে কী?’ মা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলেন তার মেয়ে সেই অনিরাপদ ভিডিও ক্লিপ ওপেন করে বসে আছে! চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শাহরিয়ার বাবার মোবাইলে ইউটিউবে মীনা কার্টুন দেখতে গিয়ে হঠাৎ বাবাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘হাজবেন্ড-ওয়াইফ লাভ স্টোরি’ বলতে কী বোঝায়? তাৎক্ষণিক সেই বাবা ছেলের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেখেন ‘ভয়ানক কিছু’। যেটি মীনা কার্টুনের মাঝপথেই ‘সাজেস্ট’ করা হয়েছিল। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী যুঁথি। একদিন খাবার টেবিলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাইকে সে জিজ্ঞেস করল- ‘আচ্ছা ভাইয়া, পতিতা বলতে কী বোঝায়?’ ধমকের সুরে বোনকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘পতিতা’ শব্দটি সে কোথায় পেয়েছে! যুঁথি উত্তর দেয়, ইউটিউবে গান দেখার সময় স্ক্রল করতে গিয়ে চোখে পড়ে ‘স্কুলের মেয়েরা কিভাবে পতিতা হচ্ছে দেখুন’। [সূত্র : মানবকণ্ঠ, ২৪.১০.২০২০] মোবাইলে দৃষ্টি দিয়ে কোমলমতি শিশুরা অভিভাবককে এমন প্রশ্ন করলে অভিভাবকের মনমর্জি কোথায় গিয়ে ধাক্কা খাবে, সেটা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে কি।
দুই দশক আগের বাস্তবতায় যেতে চাই। যখন কিশোর ছিলাম, তখন কি দেখেছি আমরা। হ্যাঁ, প্রেম ছিল- অন্তরালে, চিঠির ভাঁজে। তার মাঝে একটা শালীনতাবোধ ছিল। এখনকার মেসেঞ্জার-ভিডিও চ্যাটিংয়ের মতো খোলামেলা ছিল না সবকিছু। কখনও ‘পর্নোগ্রাফি’ শব্দটা শুনেছি বলেও মনে হয় না। বর্তমান ফেসবুক-ইউটিউবের সহজতর বাজারে পেছনে ফেলে আসা আমাদের কিশোরবয়সী সময়টা যোগ-বিয়োগ করলে ফলাফল দাঁড়ায়- যা গত হয়েছে তা ভালই ছিল। এখন কি দেখছি? ইন্টারনেটসমৃদ্ধ মোবাইল ফোনের অবাধ ব্যবহারে নাচানাচি করছে উলঙ্গ দেহ। তা দেখে শিশু-কিশোররা নিঃসন্দেহে বিপথগামী হচ্ছে। আর অভিভাবক যতই সতর্ক সাবধান থাকুক, নিজ সন্তানকে একেবারে চোখে চোখে রাখা কারও পক্ষে কি সম্ভব। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েরা কোথায় কি করছে অভিাভাবক তা জানার চেষ্টা করলেও সবসময় যে কুলিয়ে ওঠা অসম্ভব। অতএব, মোবাইল ব্যবহারে নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ জারি করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়মনীতি জারি করা কোন অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি না সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক হয়।
মোবাইল শিশু-কিশোরদের কতটা অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে তা হরহামেশাই চোখে পড়ছে। কিন্তু কিছু করার নেই, বলারও নেই। একদিন রাতে বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। তখন রাত প্রায় পৌনে নয়টা। পথিমধ্যে বৃষ্টি বাগড়ায় পড়ে সঙ্গীয় দু’তিনজনসহ সন্নিকটের এক মন্দিরের বারান্দায় গিয়ে উঠি। ধুম বৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে পাশেই বসা অল্পবয়সী ক’জন কিশোরের ওপর। বয়স বেশি হলে দশ কি এগারো হবে। তাদের দু’তিনজনের হাতে বড় টাচ্ মোবাইল। সবাই উন্মুখ হয়ে মোবাইলে কি জানি দেখছিল। আমাদের একজন তাদের একজনকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করে, তোদের কি পড়ালেখা নেই প্রশ্ন করলে- তারা তাৎক্ষণিক মোবাইল বন্ধ করে বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে এ স্থান ত্যাগ করে। এখন প্রশ্ন- এই অল্প বয়সে তাদের হাতে মোবাইল কেন? এদের অভিভাবক কি খোঁজ-খবর রাখছেন তাদের সন্তান রাতে মোবাইল নিয়ে কি করছে, কোথায় যাচ্ছে। হয়তো বা খোঁজ রাখেননি। যার ফলে অল্প বয়সেই এসব ছেলেপুলে মোবাইলে মাতাল হয়ে নিজেদের অনাকাক্সিক্ষত পথে দাঁড় করাচ্ছে। এসব দেখার দায় যেমন অভিভাবকের তেমনি রাষ্ট্রের। এ বিষয়ে নিবন্ধ লিখতে গিয়ে আরেকটা তরতাজা উদাহরণ সামনে আনতে চাইছি। ক’দিন আগে আমি আমার অফিসের পার্শ¦বর্তী একটা টিউবওয়েলে হাত-পা ধুতে যাই। সেখানে কিশোরবয়সী মুখচেনা এক ছেলেকে মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বলতে দেখি। হাত ধুতে ধুতে অনুভব করলাম অপর প্রান্ত থেকে একটি মেয়েকণ্ঠ ভেসে আসছে। দু’জনের কথা আমি স্পষ্টতই শুনতে পাচ্ছি। ছেলেমেয়ে দু’জনেই হিন্দীতে কথা বলছে। দু’জনের হিন্দী কথা এতটা না বুঝলেও একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝা হয়েছে, সেটা হলো মেয়েটি ছেলেটিকে কিছু একটা পাঠানোর কথা বলছে। তাদের কথা বলার ধরনে অনেকটা এরকম যে, সদ্যযৌবনা মেয়েটি প্রয়োজনে ভিডিওতে নিজের অঙ্গ প্রদর্শন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না।
আজ ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে রব উঠেছে সেটার জন্য কি শুধু নোংরা মন-মানসিকতাই দায়ী। না, এর কারণ হিসেবে ইন্টারনেট কানেক্টেড মোবাইলের নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। শিশুবয়সী ছেলেমেয়েরা মোবাইলে এসব উলঙ্গপনা দেখে দেখে বড় হলে তাদের মন-মস্তিষ্ক কোথায় গিয়ে ঠেকবে। কিংবা কিশোরবয়সী কোন ছেলে যৌন উত্তেজক পর্দায় মন মজালে তার দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু সুস্থ থাকবে সেটাই ভাবার বিষয়। হয়তো কেউ বলতে পারেন- তবে খারাপটা পরিহার করে আমরা ভালটা গ্রহণ করছি না কেন? বলি, আমাদের সমাজে খারাপটা বাদ দিয়ে ভাল গ্রহণের ক্ষমতা ক’জনের আছে? আমরা বেশিরভাগ মানুষই তো খারাপে ডুবে আছি। দেখুন মদ-গাঁজা জানি খারাপ। এখন এই খারাপ বস্তু যদি বাজারে সহজলভ্য করে দেয়া হয় তাহলে সেটা গ্রহণের মাত্রা বাড়বে না কমবে? ভাল-খারাপের প্রশ্নে বলব- কিছু পচলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এখন আপনি পচা বস্তুটি সরানোর বদলে যদি দুর্গন্ধ ঠেলে সরাতে যান তাহলে কি কোন লাভ হবে? দুর্গন্ধমুক্ত থাকতে হলে আগে পচা বস্তুটি সরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই দুর্গন্ধমুক্ত থাকা সম্ভব।
মোবাইলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রথমে বয়সটা বিবেচনায় আনা দরকার। শিশু-কিশোর বয়সী ছেলেপুলেরা যেভাবে অবাধে মোবাইল ব্যবহার করছে তার রাস টেনে ধরা অতীব জরুরী। তার চেয়ে বেশি জরুরী ক্ষতিকর সাইটগুলো বন্ধ করে দেয়া। আর যারা উস্কানিমূলক অনিরাপদ ভিডিও বানিয়ে ফেসবুক-ইউটিউবসহ অন্যান্য সাইটে আপলোড দিয়ে ভিউ বাড়ানোর চেষ্টা করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা একান্ত প্রয়োজন। এছাড়া ব্যবসার নামে মোবাইল কোম্পানিগুলো সহজ মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ সুবিধাসহ নানা সুবিধা দিয়ে আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ বিষয়কেও নিয়মানুবর্তিতার ভেতরে আনা দরকার। শিশু-কিশোরদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ বিষয় সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে জরুরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক।