রবীন্দ্রজয়ন্তী আজ

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ…। সেই শুভ সুন্দর ক্ষণটি আবার এসেছে। চির নূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ…। আজ শুক্রবার চির নূতনেরে স্বাগত জানানোর দিন ২৫ বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৯তম জন্মবার্ষিকী। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম হয় এই কীর্তিমানের। নব আনন্দে জাগো আজি নবরবি কিরণে …। রবির আলোয় আজ উদ্ভাসিত হবে বঙ্গদেশ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ। একইসঙ্গে বিশ্বকবি। নোবেল বিজয়ী কবি বাঙালীর অনুপ্রেরণার চিরন্তন উৎস। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির সঙ্গে তিনি মিশে আছেন।
দুই বাংলার কৃতজ্ঞ বাঙালী প্রতিবছর বিপুল আয়োজনে দিবসটি উদ্যাপন করে। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন করা হয়। তবে এবার ভিন্ন বাস্তবতা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলছে সাধারণ ছুটি। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ঘরেই অবস্থান করছেন বেশিরভাগ মানুষ। ফলে সব ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কবিগুরুর জন্মদিনের আয়োজনেও এর প্রভাব পড়বে। আজ বিশেষ কোন আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না। ছায়ানটসহ দু’ একটি সংগঠন সঙ্গীতের ভাষায় সীমিত আকারে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপন স্থগিত করা হলেও, রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যখন ভারতবর্ষ ছিল সম্পূর্ণরূপে পরাধীন। সমাজ অনগ্রসর ছিল। প্রথাগত চিন্তায় অভ্যস্ত ছিল মানুষ। ঠিক তখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তাজগতে আধুনিকতার বীজ বুনে দেয়ার গুরু দায়িত্ব নিয়ে সামনে আসেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীর মানস গঠনে অগ্রদূূতের ভূমিকা পালন করেন তিনি। বাঙালীকে আবেগ অনুভূতি প্রকাশের ভাষা দেন। উৎকৃষ্ট সৃষ্টির প্রেরণা হয়ে আসেন তিনি। বাঙালীর শিক্ষায়, নান্দনিকতার বোধে, সাংস্কৃতিক চর্চায়, দৈনন্দিন আবেগ অনুভূতি অভ্যাসে এবং সাহিত্য সঙ্গীত শিল্পকলায় বিপুল অবদান তাঁর। তিনি আছেন বাঙালীর নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, বুদ্ধি-বোধে-মর্মে-কর্মে। তিনি আমাদের লোক। তাঁকে আমরা পাই প্রেমে, প্রতিবাদে, অঙ্গীকারে এবং ¯্রষ্টার আরাধনার নিবিষ্টতায়। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে আমরা তাঁকে পেয়েছি আত্মশক্তিরূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ কর্মের মধ্য দিয়ে সূচনা করে গেছেন একটি কালের। একটি সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দিতে শুরু করেন তিনি। তাঁর পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে বাঙালীর শিল্প সাহিত্য। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদী ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন।
সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভা-ারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আজকের বদলে যাওয়া সময়েও বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন যেন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যতদিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাঁদের আবেগ-অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি।
বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবিও এঁকেছেন। প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন তিনি। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাঁর আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
মানবতাবাদী এ কবি মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর মতে, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীকে সুরের করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন: ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ। এর মধ্য দিয়ে নিজের জাতীয়তাবোধ ও প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের কল্যাণে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেও প্রশংসিত হয়েছেন। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলে গেছেন।
প্রথম জীবনে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলিতে কবিগুরু লিখেছিলেন: মরণ রে,/তুঁহু মম শ্যামসমান… মৃত্যু অমৃত করে দান। একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তাররূপে বর্ণনা করে তিনি লেখেন: প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই…। জীবনের শেষ দিকে এসে কবি জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি : মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
বলা বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার এ স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে। কবির ভাষায়, তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।/সকল খেলায় করবে খেলা এই আমিÑ আহা,/ নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,/আসব যাব চিরদিনের সেই আমি …। রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের। চির নূতন তিনি। নব নব রূপে তিনি আসেন। আজও এসেছেন।
রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিভূ। তিনি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ¯্রষ্টা। চিত্রকর, সমাজচিন্তক এবং দার্শনিক হিসেবেও বিশেষ খ্যাত। রবীন্দ্রনাথ বাঙালী জাতীয়তা-বোধের অন্যতম প্রধান রূপকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রবীন্দ্রাথ ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। তিনি ছিলেন বৈচিত্র্যের সাধক। বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম-বর্ণ-ভাষায় বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রাথের জীবন ও দর্শন উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা। বিশ্ব কবির ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে বাঙালীর অগ্রযাত্রাকে চিরকাল অব্যাহত রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর অনন্য সাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। জীবন সম্পর্কে তাঁর দুরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন ॥ ছায়ানটের পক্ষ থেকে আজ সীমিত পরিসরে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ সকাল ৯টায় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে এ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। ‘[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশওই মহামানব আসে’ শীর্ষক সংক্ষিপ্ত এ অনুষ্ঠান গ্রন্থনা করেছেন বাঙালীত্বের একনিষ্ঠ সাধক ও আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সনজীদা খাতুন।
সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও স্ব স্ব উদ্যোগে কবিগুরু রচিত নাটক, নৃত্যনাট্য প্রচার করা হবে বলে জানা গেছে। থাকবে কবিতা আবৃত্তি এবং আলোচনাও।
অন্য বছর এই দিনে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও, শিলাইদহ শাহজাদপুর পতিসর দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে রবীন্দ্রজয়ন্তীর বিশেষ অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কবিগুরুকে স্মরণ করা হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে এবার অধিকাংশ আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৯তম জয়ন্তী উদযাপন করবে আজ। পশ্চিমবঙ্গের সংগঠন ক্যালকাটাকয়্যার’র সঙ্গে যৌথভাবে রবীন্দ্র স্মরণানুুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এ বছর অনলাইনে জয়ন্তী আয়োজন করেছে দুই সংগঠন। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ১২টা (পশ্চিমবঙ্গ সময় সকালে সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা) পর্যন্ত উদীচীর ফেসবুক পেজে এই অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হবে। আয়োজনের মধ্যে থাকবে সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা ও কথামালা। এসবে অংশ নেবেন দুই বাংলার শিল্পীরা।